নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
প্রতি বছর ১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। যা ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাবের পর ১৯৯৩ সাল থেকেই পালিত হয়ে আসছে। কোরআন ও হাদিস মোতাবেক এ দারিদ্র্য দূরীকরণে ইসলামের রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে সৃষ্টির সেরা করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের সুখ-শান্তির জন্য এ ধরণীকে ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ করে রেখেছেন।
সম্পদ বণ্টনে তিনি কাউকে প্রাধান্য দিয়েছেন আবার কাউকে করেছেন নিঃস্ব। কাউকে সম্পদ দিয়ে আবার কাউকে সম্পদ নিয়ে পরীক্ষা করছেন তিনি। পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহ তায়ালার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। তাই মানুষের দায়িত্বই হচ্ছে সুখ ও শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণে আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা।
সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সবার অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। বিশেষ করে সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিদের জন্য অভাবীদের প্রতি দয়া প্রদর্শনকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কারণ দয়া প্রদর্শন এবং সহানুভূতি পাওয়াকে দরিদ্রদের অধিকার বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
দারিদ্র্যের পরিচয়
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সুন্দর পরিবেশসহ প্রয়োজনীয় কাজের অগ্রযাত্রায় অর্থের অভাবই হলো দারিদ্র্য। এ কথায়- যে কারণে মানুষ দৈনন্দিন জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো পূরণ করতে পারে না তাই দারিদ্র্য। তাছাড়া শিক্ষাব্যবস্থায় এবং মানুষের জ্ঞানে দারিদ্র্যের রয়েছে নানা রকম সংজ্ঞা। পৃথিবীতে নীতিহারা, নৈতিক চরিত্রহীন ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য। কারণ দ্বীন, ঈমান ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলেই মানুষ অর্থকষ্টে পতিত হয়।
আর অর্থের অভাবের কারণেই খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের চাহিদা প্রকট হয় বলে এগুলোকে মানুষ দারিদ্র্য বলে চিহ্নিত করেছেন। দারিদ্র্য দূরীকরণে ইসলাম দারিদ্র্যের মূলে কুঠারাঘাত করে ক্ষুধা ও অভাবমুক্ত সুন্দর সমাজ উপহার দিতে কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক বিধি-বিধান নির্ধারণ করেছে। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতির কারণে সমাজে দারিদ্র্যের মতো অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে যা থেকে বিরত থাকতে কোরআনের একাধিক জায়গায় গুরুত্বের সঙ্গে নিষেধ করা হয়েছে।
সম্পদশালী ব্যক্তিকে দারিদ্র্য দূরিকরণে এগিয়ে আসার আহ্বান
(১) ‘তিনি পৃথিবীতে তোমাদেরকে প্রতিনিধি করেছেন, কারও চেয়ে কারও মর্যাদা উন্নত করেছেন (বিভিন্ন বিষয়)। উদ্দেশ্য হলো যা দিয়েছেন সে বিষয় পরীক্ষা করা।’ (সুরা আনআম: আয়াত ১৬৪) (২) ‘আমরা দুনিয়াতে তাদের মধ্যে জীবিকা সামগ্রী বণ্টন করি, যাতে তারা একে অপরকে সেবকরূপে গ্রহণ করে।’ (সুরা যুখরুখ: আয়াত ৩২)
(৩) কাফেরদের সচ্ছলতার জ্ঞানের প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন- ‘(হে নবী) বলুন, আমার রব, যাকে ইচ্ছা রিজিকের প্রশস্ততা দেন যাকে ইচ্ছা সংকীর্ণতা দেন। কিন্তু অধিকাংশ লোকই এ ব্যাপারে অজ্ঞ।’ (সুরা সাবা: আয়াত ৩৬)
(৪) ‘মানুষকে দুর্বলমনা করে সৃষ্টি করা হয়েছে। বিপদ স্পর্শ করলে সে ঘাবড়ে যায়। আর স্বাচ্ছন্দ্য আসলে কার্পণ্য শুরু করে।’ (সুরা মাআরিজ: আয়াত ১৯-২১)
হাদিসের আহ্বান
জান্নাতিদের অধিকাংশই গরিব ও দুর্বল। আর জাহান্নামিদের অধিকাংশই ধনী, প্রতাপশালী ও নারী। তবে জান্নাতি হওয়ার জন্য যেমন দরিদ্র বা অভাবী থাকার নির্দেশ দেয়া হয়নি; তেমনি জাহান্নামি হওয়ার জন্য ধনী, ক্ষমতা কিংবা নারীদের নারিত্বকে দায়ী করা হয়নি। ইসলামি জীবন বিধানে এরূপ অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন-
ক. দারিদ্র্য অনেক সমস্যার অন্যতম এবং জীবিকার প্রাচুর্যও অনেক নিয়ামতের অন্যতম। ব্যক্তি, সময় ও স্থানভেদে দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য দান মহান আল্লাহর কৌশলেরই বৈচিত্র্য ও স্থায়ী নীতি।
খ. সব মানুষই আল্লাহর নির্ধারিত অবস্থানে থেকে আনুগত্যের পরীক্ষা দিচ্ছে। অভাব বা সচ্ছলতা নয়, ব্যক্তির মানসিকতা অবাধ্যের কারণ। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) অভাব ও প্রাচুর্যের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন।’ (দাউদ শরিফ)
দরিদ্রদের দানে কোরআনের নির্দেশ ও নসিহত
* ইসলাম ক্রীতদাসকে মুক্ত করা ও দুর্ভিক্ষের সময় অভাবগ্রস্তদের দান করাকে হেদায়েত পাওয়ার শর্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি কি তাকে দান করিনি দুই চোখ, জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট? মূলত আমি তাকে দু’টি পথ দেখিয়েছি। এরপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সে ঘাঁটি কী? তা হচ্ছে দাসমুক্তি। অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে ইয়াতিম আত্মীয়কে অথবা নিঃস্ব মিসকিনকে খাদ্য দান। অতঃপর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবরের ও উপদেশ দেয় দয়ার। তারাই সৌভাগ্যশালী। (সুরা বালাদ: আয়াত ৮-১৮)
দারিদ্র্য দূরীকরণে এগিয়ে এলে পরকালের মুক্তি
আল্লাহ বলেন- ‘সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ ফেরাবে (নামাজ পড়বে) বরং বড় সৎকাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামতের দিনের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সমস্ত নবী-রাসুলগণের ওপর। আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকিন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে।’ (সুরা বাক্বারা: আয়াত ১৭৭)
অভাবমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে কোরআনি নির্দেশনা
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতইনা উত্তম। আর যদি দান গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম। (বিনিময়ে) আল্লাহ তোমাদের কিছু গোনাহ দূর করে দেবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্মের খুব খবর রাখেন।’ (সুরা বাক্বারা: আয়াত ২৭১)
দরিদ্রদের দান করা সর্বোত্তম
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় কর এবং তা থেকে নিকৃষ্ট জিনিস ব্যয় করতে মনস্থ করো না। কেননা, তোমরাই তা কখনো গ্রহণ করবে না; তবে যদি তোমরা চোখ বন্ধ করে নিয়ে নাও। জেনে রেখো, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত। (সুরা বাক্বারা: আয়াত ২৬৭)
দরিদ্রদের দানে হাদিসের নির্দেশ
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুর্বল, অসহায় ও নিঃস্বদের ওছিলাতেই সচ্ছল মানুষরা (আল্লাহর) সাহায্য ও রিজিকপ্রাপ্ত হয়।’ এখানে একইসঙ্গে নিঃস্বদের মর্যাদা ও অধিকার বিবৃত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকো; একটি খেজুরের অর্ধেক দিয়ে হলেও।’
আইন প্রয়োগ ও সুষম অর্থব্যবস্থা প্রণয়ন
আইন প্রয়োগ করে দারিদ্র্য দূরীকরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত আদায় ও তা বণ্টন। দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত আদায়ের ব্যবস্থা না থাকায় এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় জাকাতের অর্থ উত্তোলন ও বণ্টন হচ্ছে না। ফলে দিন দিন অভাবী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ইসলামি বিধি-বিধান অনুযায়ী দান-অনুদান, সম্পদশালী ব্যক্তিদের সমুদয় অর্থের জাকাত আদায় ও খাদ্যশস্যের ওসর আদায় করে জাকাত ফান্ডে জমা করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। অতঃপর জাকাত ফান্ডের অর্থ সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে অভাবী মানুষের মধ্যে সুষম বণ্টন করতে পারলে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী অল্প সময়ের ব্যবধানে সচ্ছলতায় ফিরে আসবে। সমাজে কোনো গরিব মানুষ থাকবে না। এক সময় এসব গরিব মানুষও সরকারের রাজকোষে তাদের জাকাতের অর্থ জমা দেবে। ফলে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে রাষ্ট্র।
পরিশেষে, আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে প্রিয়নবী (সা.) ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত থাকতে কাজের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কর্মের প্রতি মানুষকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রণয়নের ঘোষণা দিয়েছেন। যা সহজেই মানুষকে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এক গরিব ব্যক্তি তার নিজের ও পরিবারের ক্ষুধার যন্ত্রণায় প্রিয়নবীর কাছে খাদ্য চাইলে তিনি গরিব ব্যক্তিকে কাজের বিনিময়ে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও অন্যকে সহযোগিতার উপদেশ ও কর্মনীতি প্রদান করেন। তাই দারিদ্র্য দূরীকরণে কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক দানশীলতা, মানবিক মূল্যবোধ ও রাষ্ট্রীয় মালিকানায় দান-অনুদান ও জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখা অত্যন্ত জরুরি।
আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে পাড়ায়, মহল্লায়, সমাজে, ইউনিয়নে, উপজেলায়, জেলায় তথা দেশব্যাপী কোরআন-সুন্নাহর হুকুম মোতাবেক জাকাত ও দান-অনুদান প্রদানের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
নয়াশতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ