নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পিতা আব্দুল্লাহ, একদিন মক্কার বাজারে গিয়েছিলেন কিছু কেনাকাটা করার জন্য। এক জায়গায় তিনি দেখলেন, এক লোক কিছু দাস-দাসী নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিক্রি করছে। আব্দুল্লাহ দেখলেন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট নয় বছরের কালো আফ্রিকান আবিসিনিয়ার মেয়ে। মেয়েটাকে দেখে আব্দুল্লাহর অনেক মায়া হলো, একটু রুগ্ন হালকা-পাতলা কিন্তু কেমন মায়াবী ও অসহায় দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
তিনি ভাবলেন ঘরে আমেনা একা থাকেন, মেয়েটা পাশে থাকলে তার একজন সঙ্গী হবে। এই ভেবে তিনি মেয়েটাকে কিনে নিলেন। মেয়েটিকে আব্দুল্লাহ ও আমেনা অনেক ভালোবাসতেন। স্নেহ করতেন। তারা লক্ষ্য করলেন যে, তাদের সংসারে আগের চেয়েও বেশি রহমত ও বরকত চলে এসেছে। এ কারণে আব্দুল্লাহ ও আমেনা মেয়েটিকে আদর করে নাম দিলেন ‘বারাকাহ’।
তারপর একদিন আব্দুল্লাহ, ব্যবসার কারণে সিরিয়া রওনা দিলেন। আমেনার সঙ্গে সেটাই ছিল তার শেষ বিদায়। তার যাত্রার দুই-একদিন পর আমেনা একরাতে স্বপ্নে দেখলেন, আকাশের একটা তারা যেন খুব আলো করে তার কোলে এসে পড়ল। পরদিন ভোরে তিনি বারাকাকে এ স্বপ্নের কথা বললেন। উত্তরে বারাকা মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার মন বলছে আপনার একটা সুন্দর সন্তানের জন্ম হবে।’ আমেনা তখনও জানতেন না তিনি গর্ভধারণ করেছেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি বুঝতে পারলেন, বারাকার ধারণাই সত্যি।
আব্দুল্লাহ আর ফিরে আসেননি, সিরিয়ার পথেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আমেনার সেই বিরহ ও কষ্টের সময়ে, বারাকা ছিলেন একমাত্র নিকটতম সঙ্গী। একসময় আমেনার অপেক্ষা শেষ হয় এবং তিনি জন্ম দেন আমাদের প্রিয় নবীকে।
বর্ণনা অনুযায়ী, সর্বপ্রথম আমাদের নবীকে দেখার ও স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়েছিল যে মানুষটির, সে হলো এই আফ্রিকান ক্রীতদাসী ছোট কালো মেয়েটি। আমাদের নবীকে নিজ হাতে আমেনার কোলে তুলে দিয়েছিলেন, আনন্দে ও খুশিতে বলেছিলেন, ‘আমি কল্পনায় ভেবেছিলাম সে হবে চাঁদের মতো কিন্তু এখন দেখছি, সে যে চাঁদের চেয়েও সুন্দর।’
এই সেই বারাকা। নবীজির জন্মের সময় তার বয়স ছিল ১৩ বছর। ছোটবেলায় শিশু নবীকে আমেনার সঙ্গে যত্ন নিয়েছেন, গোসল দিয়েছেন, খাওয়াতে সাহায্য করেছেন, আদর করে ঘুম পাড়িয়েছেন।
মৃত্যুর সময় আমেনা বারাকার হাত ধরে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন তার সন্তানকে দেখে শুনে রাখেন। বারাকা তাই করেছিলেন। বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে এতিম নবী চলে আসলেন দাদা আবদুল মোত্তালিবের ঘরে।
উত্তরাধিকার সূত্রে নবী হলেন বারাকার নতুন মনিব। কিন্তু তিনি একদিন বারাকাকে মুক্ত করে দিলেন। বললেন, ‘আপনি যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারেন, আপনি স্বাধীন ও মুক্ত।’
সেই শিশুকাল থেকেই নবী এই ক্রীতদাস প্রথাকে দূর করতে চেয়েছিলেন। বারাকা নবীকে ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। রয়ে গেলেন। মায়ের ছায়া হয়ে পাশে থেকে গেলেন।
এমনকি নবীজি (সা.)-এর দাদা তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। তার একই কথা— ‘আমি আমেনাকে কথা দিয়েছি, আমি কোথাও যাব না।’
তারপর একদিন খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে নবীজি (সা.)-এর বিয়ে হলো। বিয়ের দিন রাসুল (সা.) খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে বারাকাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ‘ইনি হলেন আমার মায়ের পর আরেক মা।’
বিয়ের পর রাসুল (সা.) একদিন বারাকাকে ডেকে বললেন, ‘উম্মি! আমাকে দেখাশুনা করার জন্য এখন খাদিজা আছেন, আপনাকে এখন বিয়ে করতেই হবে।’ (নবীজি তাকে উম্মি ডাকতেন, নাম ধরে ডাকতেন না।)
তারপর রাসুল (সা.) ও খাদিজা মিলে তাকে উবাইদ ইবনে জায়েদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর বারাকার নিজের একটা ছেলে হলো, নাম আইমান। এরপর থেকে বারাকার নতুন নাম হয়ে গেল ‘উম্মে আইমান’।
একদিন বারাকার স্বামী উবাইদ মৃত্যুবরণ করেন। নবীজি (সা.) গিয়ে আইমান ও বারাকাকে সঙ্গে করে নিজের বাড়ি নিয়ে আসেন এবং সেখানেই থাকতে দিলেন।
কিছুদিন যাওয়ার পর নবীজি একদিন বেশ কয়েকজন সাহাবিকে ডেকে বললেন, ‘আমি একজন নারীকে জানি, যার কোনো সম্পদ নেই। বয়স্ক এবং সঙ্গে একটা এতিম সন্তান আছে। কিন্তু তিনি জান্নাতি, তোমাদের মধ্যে কেউ কি এমন একজন জান্নাতি নারীকে বিয়ে করতে চাও?’
এ কথা শুনে জায়েদ ইবনে হারিসা (রা.) নবীজির কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। নবীজি (সা.) উম্মে আইমানের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের আয়োজন করলেন।
বিয়ের দিন রাসুল (সা.) জায়েদকে বুকে জড়িয়ে আনন্দে ও ভালোবাসায়, ভেজা চোখে, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি কাকে বিয়ে করেছ, জানো জায়েদ?’
-হ্যাঁ, উম্মে আইমানকে— জায়েদের উত্তর। নবীজি (সা.) বললেন, ‘না, তুমি বিয়ে করেছ আমার মাকে।’
সাহাবিরা বলতেন, রাসুল (সা.)-কে খাওয়া নিয়ে কখনো জোর করা যেত না। তিনি সেটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু উম্মে আইমান একমাত্র নারী, যিনি রাসুল (সা.) কে খাবার দিয়ে ‘খাও’.. ‘খাও’.. বলে তাড়া দিতেন। খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাশে বসে থাকতেন। নবীজি (সা.) মৃদু হেসে চুপচাপ খেয়ে নিতেন।
রাসুল (সা.) তার দুধ মাতা হালিমাকে দেখলে যেমন করে নিজের গায়ের চাদর খুলে বিছিয়ে তার ওপর হালিমাকে বসতে দিতেন। ঠিক তেমনি মদিনায় হিজরতের পর দীর্ঘ যাত্রা শেষে উম্মে আইমান যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন নবীজি (সা.) তাঁর গায়ের চাদরের একটা অংশ পানিতে ভিজিয়ে উম্মে আইমানের মুখের ঘাম ও ধুলোবালি নিজ হাতে মুছে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘উম্মি! জান্নাতে আপনার এইরকম কোনো কষ্ট হবে না।
নবীজি (সা.) মৃত্যুর আগে সাহাবিদের অনেক কিছুই বলে গিয়েছিলেন। সেই সব কথার মধ্যে একটা ছিল, উম্মে আইমানের কথা। বলেছেন, ‘তোমরা উম্মে আইমানের যত্ন নেবে, তিনি আমার মায়ের মতো ও তিনিই একমাত্র নারী, যিনি আমাকে জন্ম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছেন। আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য, যিনি সারাজীবন আমার পাশে ছিলেন।’
সাহাবিরা সেই কথা রেখেছিলেন। গায়ের রং নয়, এক সময়ের কোনো ক্রীতদাসী নয়, তার পরিচয় তিনি যে নবীজির আরেক মা। মায়ের মতোই সাহাবায়ে কেরাম এই বৃদ্ধা নারীকে ভালোবেসে আগলে রেখেছিলেন।
সূত্র: ইবনে হিশাম
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ