ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

হালাল রিজিক অর্জনের কিছু উপায়

প্রকাশনার সময়: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৩৪

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদত করার জন্য। আর যে কোনো ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হালাল রিজিক। হালাল রিজিক কিভাবে অর্জন করা যাবে তা নিয়েই আজকের লেখা।

১. আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ঈমান আনা এবং তাকওয়া ও পরহেজগারি অর্জন করা। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন, ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেন।’ (সুরা তালাক: ২-৩)

ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, আল্লাহকে ভয় করা- এর ব্যাখা হলো, ‘তার আদেশ মেনে চলা, নিষেধ থেকে বেঁচে থাকা। ফলে আল্লাহ তাকে কোনো না কোনো উপায়ে রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন এবং এমন জায়গা থেকে ব্যবস্থা করে দেবেন, যা তার কল্পনাতে কখনও আসেনি।’

বিষয়টি একদম বাস্তব। কোরআনেরই আরেকটি আয়াত দেখুন, ‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং আল্লাহর ভয় অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানি ও পার্থিব নিয়ামতসমূহ উম্মুক্ত করে দিতাম।’ (সুরা আরাফ: ৯৬)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালার ওপর ঈমান তাকওয়া ও পরহেজগারি অর্জনের শর্তে আসমান ও জমিনের বরকত লাভের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং আমাদের উচিত ঈমানে দৃঢ় হওয়া এবং তাকওয়া অর্জন করা। তবেই তো জমিন আর আসমানের বরকত পরিপূর্ণভাবে লাভ হবে। ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানে আমু নদীতে সন্ধান পাওয়া কাশকারি তেলের খনি, দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হেলমান্দে ইউরেনিয়ামসহ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটি এই আয়াতের চাক্ষুষ প্রমাণ হিসেবে মিলিয়ে নিতে পারি।

সর্বোপরি আমাদের রিজিক নিয়ে এত চিন্তা কেন? যখন তাকদীরে লেখা হয়ে গেছে, রিজিকের শেষ লোকমা গ্রহণ না করা পর্যন্ত মৃত্যু হবে না! আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সেই সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, কোনো প্রাণ তার রিজিক পূর্ণ করার পূর্বে মারা যাবে না, তাই আল্লাহকে ভয় কর এবং অন্বেষণে উদার হও।’ (তাবারানি)

২. বেশি বেশি ইসতেগফার করা

প্রখ্যাত তাবেয়ি হাসান বসরি (রহ.)-এর কাছে এক লোক এসে বলল, ‘হে আবু সাইদ, আমার স্ত্রীর সন্তান হচ্ছে না, কী করব? তিনি বললেন, বেশি বেশি ইসতেগফার পড়ো। আরেকজন এসে নিজের দরিদ্রতার কথা বলল। তাকেও ঠিক একই পরামর্শ দিলেন, বেশি বেশি ইসতেগফার পড়ো। তো একজন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর, একজন আপনার কাছে সন্তানের কথা বলল আপনি তাকে বেশি বেশি ইসতেগফার করতে বললেন। আরেকজন সম্পদের কথা বলল তাকেও একই পরামর্শ দিলেন! তো হাসান বসরি (রহ.) তাকে এই আয়াতটি পড়তে বললেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর বলেছি: তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন।’ (সুরা নুহ: ১০-১২)

নিশ্চয় ইসতেগফার হলো, বিপদআপদ, অভাব-অনটন ইত্যাদি সব সমস্যা সমাধানের বড় হাতিয়ার। তাই আমাদের উচিত রিজিকের জন্যও বেশি বেশি ইসতেগফার পাঠ করা।

৩. বেশি বেশি নামাজ পড়া

মুসনাদে আহমেদ বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে নামাজে মশগুল হয়ে যেতেন। কোরআনে বর্ণিত আছে, ‘আপনি আপনার পরিবারের লোকদেরকে নামাজের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন। আমি আপনার কাছে কোনো রিজিক চাই না। আমি আপনাকে রিজিক দেই এবং আল্লাহ-ভীরুতার পরিণাম শুভ।’ (সুরা ত্বহা: ১৩২)

এজন্য বিদ্বানরা বলেছেন, নামাজ আর ধৈর্যধারণ হালাল রিজিক অর্জনের অন্যতম মাধ্যম।

৪. বেশি বেশি দরুদ শরিফ পড়া

উবাই (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমি তো অধিকহারে আপনার প্রতি দরূদ পাঠ করি। আপনার প্রতি দরূদ পাঠের জন্য আমি আমার সময়ের কতটুকু খরচ করব? তিনি বললেন, তুমি যতক্ষণ ইচ্ছা কর। আমি বললাম, এক-চতুর্থাংশ সময়? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু ইচ্ছা কর, তবে এর চেয়ে অধিক পরিমাণে পাঠ করতে পারলে এতে তোমারই মঙ্গল হবে। আমি বললাম, তাহলে আমি কি অর্ধেক সময় দরূদ পাঠ করব? তিনি বললেন, তুমি যতক্ষণ চাও, যদি এর চেয়েও বাড়াতে পারো সেটা তোমার জন্যই কল্যাণকর।

আমি বললাম, তাহলে দুই-তৃতীয়াংশ সময় দরূদ পাঠ করব? তিনি বললেন, তুমি যতক্ষণ ইচ্ছা কর, তবে এর চেয়েও বাড়াতে পারলে তোমারই ভালো। আমি বললাম, তাহলে আমার পুরো সময়টাই আপনার ওপর দরূদ পাঠে কাটিয়ে দেব? তিনি বললেন, ‘তাহলে তোমার চিন্তা ও কষ্টের জন্য তা যথেষ্ট হবে এবং তোমার পাপসমূহ ক্ষমা করা হবে।’ (তিরমিজি)

আর মানুষের সবচেয়ে বড় চিন্তা হলো, রিজিকের টেনশন। যা চেষ্টার পাশাপাশি বেশি বেশি ইসতেগফার, নামাজ আর দরুদের মাধ্যমে দূর হয়।

৫. আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখা

এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগণ্য হলো, পিতামাতা, তারপর নিজ স্ত্রী সন্তান তারপর ভাইবোন। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার কাছে একটি দিনার আছে। তিনি বললেন, নিজের ওপর খরচ কর। তিনি বললেন, আমার আরেকটি আছে, তিনি বললেন, তা তোমার পিতামাতার জন্য ব্যয় কর, তিনি বললেন, আমার আরেকটি আছে, তিনি বললেন, তোমার সন্তানের জন্য ব্যয় কর। তিনি বললেন, আমার আরেকটি আছে। তিনি বললেন, তোমার সন্তানের জন্য ব্যয় কর। তিনি বললেন, আমার আরেকটি আছে। তিনি বললেন, তোমার গোলামের জন্য ব্যয় কর। তিনি বললেন, আমার আরেকটি আছে। তুমি এটা জমা রাখো। (বায়হাকি)

অন্য আরেকটি হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে যে আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখার মাধ্যমে রিজিকে সমৃদ্ধি ঘটে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি চায় তার জীবিকা প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বৃদ্ধি হোক, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখে।’ (বুখারি)

আমাদের অনেককে দেখা যায়। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। বিশেষ করে সে যদি সচ্ছল হয় তবে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ অভাবি বা গরিব থাকলে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করে না। অনেক ক্ষেত্রে আত্মীয় নয় এমন লোকজনকে সাহায্য করে কিন্তু নিকটস্থ আপনজনের ব্যাপারে বেখেয়াল। অথচ হাদিসে আছে, নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য-সহযোগিতা করলে দুই সওয়াব। এক হলো, আত্মীয়তা রক্ষা করার আরেকটি হলো সদকা করার।

৬. হজ ও উমরা করা

আব্দুল্লাহ ইববে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পরপর হজ ও উমরা করো। কারণ এ দু’টি দারিদ্র্য ও গুনাহ এমনভাবে দূর করে, যেমনভাবে হাঁপর লোহা ও স্বর্ণ-রুপার ময়লা দূর করে দেয়।’ (তিরমিজি ও নাসায়ি)

৭. বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া

বিবাহ হলো হালাল রিজিক প্রাপ্তির অন্যতম মাধ্যম। তবে বিবাহ হতে হবে লৌকিকতামুক্ত, শরিয়তের উদ্দেশ্য প্রণোদিত, সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে সমৃদ্ধ। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমি কি তোমাদের লাভজনক ব্যবসার কথা জানাব না। উপস্থিত জনতা বলল, জি কেন নয়! তিনি বললেন, বিবাহ। তারা বলল, হে আব্দুর রহমান, বিবাহ করতে তো টাকার প্রয়োজন হয় তাহলে এটা কীভাবে লাভজনক ব্যবসা হতে পারে। সাহাবি ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, আচ্ছা তবে (বিয়ে প্রসঙ্গে) আল্লাহর এই বাণী পাঠ করো, ‘তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ ( সুরা নুহ: ৩২)

প্রিয় পাঠক, উপরে হালাল রিজিকের মাত্র কয়েকটি মাধ্যমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে আরও অনেক উপায়ে আমরা হালাল রিজিকের নিয়ামতে ধন্য হতে পারি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই সে সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমিনে রয়েছে সে সমস্ত।’ (সুরা বাকারা: ২৯)

এজন্যই শরিয়তের মূলনীতি হলো, জিনিসের মূল হলো হালাল হওয়া। আর হালালের ব্যাপ্তি নিশ্চয়ই ব্যাপক ও সুবিস্তৃত। তাই আমরা হালাল রিজিক অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকব।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ