নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
সপ্তম হিজরি। শাওয়াল অথবা জিলকদ মাস। মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন রাসুল (সা.)। সঙ্গে তাঁর বিশাল বাহিনী। উদ্দেশ্য উমরায়ে কাজা আদায় করা। গত বছরের (ষষ্ঠ হিজরি) ওমরা ছিল এটি। হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তের কারণে এ বছর কাজা আদায় করতে হচ্ছে সবাইকে। রাসুল (সা.) এর সঙ্গে আছেন চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবু তালেব (রা.)। তিনি জাফরকে বললেন, আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে হারেস আল কুরাইশির কন্যা মায়মুনাকে বিবাহ করার জন্য। আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে প্রস্তাব পাঠাও। জাফর (রা.) মায়মুনার (রা.) কাছে রাসুল (সা.) এর পক্ষ থেকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। তিনি সানন্দে রাজি হলেন এবং বিবাহের সার্বিক কার্যক্রম আব্বাস (রা.) এর ওপর অর্পণ করেন। আব্বাস (রা.) ছিলেন রাসুল (সা.) এর আপন চাচা এবং মায়মুনা (রা.) এর আপন দুলাভাই। রাসুল (সা.) ইহরাম অবস্থায় চাচার মাধ্যমে জানতে পারলেন, মায়মুনা (রা.) বিবাহে রাজি হয়েছেন। তিনি (সা.) ওই অবস্থায়ই ৫০০ দিরহামের বিনিময় তাকে বিয়ে করেন। আর এভাবেই উম্মুল মোনীন তথা মোমিনজননীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন তিনি। (জাদুল মাআদ: ২/১৫২)
ইবনে সাদের মতে, রাসুল (সা.) ইহরাম হতে হালাল হয়ে মায়মুনা (রা.) এর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। রাহিকুল মাখতুম গ্রন্থকারের মতে এটিই বিশুদ্ধ বর্ণনা। এ প্রসঙ্গে ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) উপরোক্ত দুই মতের সমন্বয় সাধন করে বলেন, ‘ইহরাম অবস্থায় আকদ সম্পন্ন হয়েছে; আর হালাল হওয়ার পর বিবাহের বাদ বাকি কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে।’ এ কথা মেনে নিলে আর কোনো বিরোধ থাকল না। (আল ইসাবা: ৮/১৯২)। তবে এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই যে, মায়মুনা (রা.)-ই ছিলেন রাসুল (সা.) এর সর্বশেষ স্ত্রী। এরপর তিনি (সা.) আর কোনো বিয়ে করেননি। (তাবাকাতুল কুবরা: ৮/১৩৫)
রাসুল (সা.) এর সঙ্গে বিয়ের আগে তার নাম ছিল বাররা। বিয়ের পর রাসুল (সা.) নাম রাখলেন মায়মুনা। (আল ইস্তিআব: ৪/১৯১৫।) বিখ্যাত কুরাইশ বংশে তার জন্ম। পিতার নাম হারিস বিন হাজন আল কুরাইশি; মাতার নাম হিন্দ বিনতে আউফ। মায়ের বংশ নিয়ে দুটি মত পাওয়া যায়। কারো মতে, তার মা ছিলেন হুমাইরা গোত্রের মেয়ে, আবার কেউ বলেছেন, তার মা ছিলেন কেনান গোত্রের বাসিন্দা। (মুখতাব আজওয়াজুন নবী: ৬৩)। রাসুল (সা.) এর সঙ্গে বিয়ের আগে মায়মুনা (রা.) মাসউদ বিন আমর বিন উমায়ের আস-সাকাফীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। মাসউদ ছিল তার প্রথম স্বামী। মাসউদ তাকে তালাক দিলে তিনি বনু মালিক গোত্রের আবু রহম বিন আবদুল উজ্জাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন। কিছুদিনের মধ্যে আবু রহমও মারা যায়। প্রথম স্বামীর বিচ্ছেদের পর দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যু কষ্ট যেন মায়মুনার (রা.) জীবনকে বিষিয়ে তুলল। তিনি ইচ্ছা করলেন, এ জীবনে আর বিয়ে করবেন না। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছিল আরও বেশি কল্যাণকর। তাই রাসুল (সা.) এর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মায়মুনা (রা.) এর দুঃখের জীবনকে সুখের স্বর্গে পরিণত করলেন দয়াময় আল্লাহ।
ব্যক্তি জীবনে মায়মুনা (রা.) ছিলেন খুবই পরহেজগার। তার সম্পর্কে আরেক উম্মুল মোমিনীন আয়শা (রা.) বলেন, ‘তিনি ছিলেন, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান এবং আত্মীয়-স্বজনদের অধিকার রক্ষা সচেতন।’ (সিয়ারু আলামিন নুবলা: ২/২৪৪) তিনি কখনই আল্লাহর নাফরমানিকে বরদাস্ত করেননি। এমনকি আত্মীয়দের বেলায়ও নয়। এক নিকটাত্মীয় মদপান করে তার কাছে আসলে তিনি কঠিন ধমকের সঙ্গে বলে দেন এভাবে যেন আর কখনও তার সামনে না আসে। (সিয়ারু আলামিন নুবলা: ২/২৪৪)
শরিয়তের বিধানের ব্যাপারে তিনি যেমন ছিলেন কঠোর তেমনি আকিদার বিষয়েও তিনি ছিলেন সচেতন। একবার একজন মহিলা তার কাছে আসল মসজিদে আকসায় যাওয়ার আরজি নিয়ে। মহিলা বলল, আমি খুব কঠিন অসুখে পড়েছিলাম। ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েও কোনো সুফল পাচ্ছিলাম না। সবশেষ নিয়ত করি, আল্লাহ যদি আমাকে সুস্থ করেন, তবে আমি মসজিদের আকসায় গিয়ে নফল সালাত আদায় করব। এ কথা শুনে মায়মুনা (রা.) বললেন, মসজিদে আকসার চেয়ে মসজিদে নববী বেশি মর্যাদাবান। এভাবে নিজেকে কষ্ট দেয়ার কোনো মানে হয় না। আপনি বরং মসজিদে নববীতেই নফল সালাত আদায় করুন। (মুসনাদে আহামাদ: ৬/৩৩৩)
উম্মুল মোমিনীন মায়মুনা (রা.) সুন্নাতে নববীর কঠোর অনুসারী ছিলেন। সুন্নাতের খেলাফ কোনো কাজ কখনই তিনি বরদাস্ত করতেন না। একবার তার দাসী মারফত জানতে পারলেন, হজরত আব্বাস (রা.) তার স্ত্রীকে বিশেষ সময় পৃথক রাখেন। এ শুনে তিনি খুব রাগ হন এবং বলেন, ওই সময় রাসুল (সা.) আমাদের সঙ্গে বসতেন, একই বিছানায় শুতেন, এমনকি আমাদের কোলে মাথা রেখে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। হে আব্বাস! আপনি কি রাসুলের সুন্নাতের বিরোধিতা করছেন? (মুসনাদে আহমাদ: ৬/৩৩৩)। আরেকদিন আব্বাস (রা.) এর ছেলে আবদুল্লাহ (রা.) মায়মুনা (রা.) এর কাছে আসলেন। তিনি আবদুল্লাহ (রা.)-কে বললেন, বাবা! তোমার মাথার চুল এলোমেলো কেন? মনে হয় চিরুনি করোনি। তিনি বললেন, খালাম্মা! আমার স্ত্রী আমার মাথায় চিরুনি করে দেয়। কিন্তু সে এখন অপবিত্র। তাই আমি তার স্পর্শ থেকে দূরে আছি। এ কথা শুনে মায়মুনা (রা.) বললেন, বাবা হাতেও কি অপবিত্র থাকে? এমন সময় তো আমরা রাসুলের মাথায় চিরুনি করে দিতাম। (মুসানাদে আহমাদ: ৩৩১)।
হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রে মায়মুনা (রা.) এর অবদান ছিল উল্লেখ করার মতো। মুহাদ্দেসদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট ৭৭টি হাদিস তিনি বর্ণনা করেছেন প্রিয় নবী (সা.) থেকে। তার অধিকাংশ হাদিসই ছিল পবিত্রতা কেন্দ্রিক। ইবনে আব্বাস, শাদ্দাদ ইবনে হাদ, আতা ইবনে ইয়াসার, ইবরাহিম ইবনে আবদুল্লাহ, আলিয়া বিনতে সাবী সহ প্রমুখ সাহাবী ও তাবেয়ীরা তার ছাত্র ছিলেন। (আত-তালকীহ: ৩৫৬)
এ মহান মহীয়সী ৫১ হিজরি মোতাবের ৬৭১ খ্রিস্টাব্দে মদিনা থেকে মক্কার পথে সরফ নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। তার জানাজা এবং দাফন কার্য সম্পাদন করেন তার বোনের ছেলে প্রখ্যাত মুফাসসির হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)। তিনি যখন মাইয়্যেতকে কাঁধে নিচ্ছিলেন তখন সাথীদের এই বলে সতর্ক করে দেন, সাবধান! ইনি আল্লাহর নবীর স্ত্রী। লক্ষ্য রেখো তার সঙ্গে যেন কোনো প্রকার বেয়াদবি না হয়। (বুখারি: ২/৭৫৮)
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ