ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৩, ২০ আশ্বিন ১৪৩০, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

খ্রিস্টধর্মের প্রচারক থেকে যেভাবে হলেন কোরআনের সাধক

প্রকাশনার সময়: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৪১

কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও যুক্তিবিদ্যার অধ্যাপক ড. গ্যারি মিলার। অত্যন্ত সৌম্যদর্শন ফর্সা চেহারার অধিকারী মানুষ। খ্রিস্টধর্মের একজন সক্রিয় প্রচারক ছিলেন তিনি। বাইবেল বিষয়ে ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য। বিশিষ্ট দাঈ শায়খ আহমদ দিদাতের সঙ্গে কোরআন ও বাইবেল ইস্যুতে ডিবেট হয়েছিল ড. গ্যারির। কেবল ভুল খুঁজে বের করার অভিপ্রায় নিয়েই কোরআন অধ্যয়নে ব্যাপৃত হয়েছিলেন তিনি।

তার ধারণা ছিল, আল কোরআন যেহেতু চৌদ্দশ বছরের প্রাচীন গ্রন্থ, কাজেই সেখানে নিশ্চয় মরুভূমি বিষয়ক কোনো কথাবার্তাই থেকে থাকবে! নিজের পাণ্ডিত্যের ওপর অগাধ বিশ্বাসের কারণেই তিনি ধরে নিয়েছিলেন-আল কোরআনের ঐতিহাসিক, ব্যাকরণগত এবং ম্যাথম্যাটিক্যাল অনেক ভুল তিনি খুঁজে পাবেন। ফলে মুসলিমদের কুপোকাত করার মোক্ষম অস্ত্র চলে আসবে তার হাতে। কিন্তু আল কোরআন যে তার পাণ্ডিত্যকেই প্রশ্নের মুখোমুখি করবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি।

কোরআন অধ্যয়নের একদম শুরুতেই ধাক্কা খেলেন তিনি। পৃথিবীর কোনো লেখকই আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারে না— তার লেখা বইয়ে কোনো ভুল নেই। আল কোরআনই একমাত্র ব্যতিক্রমী গ্রন্থ, যার শুরুতেই বলা হচ্ছে— This is the book, there is no doubt about it. [Surah Bakarah : 02] অর্থাৎ, এটি এমন একটি গ্রন্থ, যাতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। ড. গ্যারি মিলার আগে কখনো এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজের বইকে নির্ভুল বলতে দেখেননি কোনো লেখককে। তার বিস্ময়ের সীমা রইল না।

শুধু তা-ই নয়, এর বিভিন্ন আয়াতে কোরআনের প্রতি সন্দেহ পোষণকারীদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হচ্ছে। কোরআনের ভুল খুঁজতে বসে ড. গ্যারির মনে হলো— স্বয়ং কোরআনই যেন চ্যালেঞ্জ করছে তাকে। সুরা নিসার একটি আয়াতে বলা হচ্ছে, Do they not then reflect on the Quran? Had it been from anyone other than Allah, they would have certainly found in it many inconsistencies. [Surah Nisa : 82] অর্থাৎ, তবে কি তারা কোরআন সম্পর্কে অনুধাবন করে না? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে আসত, তবে তারা তাতে বহু অসংগতি খুঁজে পেত।

ড. গ্যারি মিলার এবার নড়েচড়ে বসলেন। গভীর বিস্ময় নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে থাকলেন সামনের দিকে। তাকে আরও অবাক করল, যখন দেখলেন— সমগ্র কোরআনে নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর ব্যক্তিগত জীবন প্রায় অনুল্লিখিত। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.), প্রাণপ্রিয় চাচা আবু তালিব এবং ছেলেমেয়েদের ইন্তেকাল; কোনো কিছুই এখানে স্থান পায়নি। যদি এটা তাঁর নিজের লিখিত কোনো গ্রন্থ হতো, তাহলে তো তাঁর দৈনন্দিন জীবনের অনেককিছুই স্থান পেতো এতে!

তিনি আরও অনেকগুলো বিষয় অবলোকন করে যুক্তির সঙ্গে যুক্তি মিলিয়ে নিঃসন্দেহ হলেন— এটি কোনোভাবেই মুহাম্মাদ (সা.) লিখিত কোনো গ্রন্থ নয়। বিশেষত কিছু যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলিমদের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে এবং বিজয়ের পর দম্ভ-অহংকারের পরিবর্তে আরো বেশি প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদি তা মুহাম্মাদ (সা.) রচিত কোনো গ্রন্থ হতো, তাহলে তাতে জয়-পরাজয়ের নানা কারণ বর্ণনা করতেন তিনি। অথচ ব্যক্তিগত প্রশংসা সংক্রান্ত কোনো কথাই সেখানে বলা নেই।

কোরআনের একটি জায়গায় বলা হচ্ছে, Say, I only advise you of one [thing] that, you stand for Allah, [seeking truth] in pairs and individually and then give thought. There is not in your companion any madness. He is only a warner to you before a severe punishment. [Surah Saba: 46] অর্থাৎ, বলুন! আমি তোমাদের একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি— তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দুজন-দুজন অথবা একজন একজন করে দাঁড়াও, অতঃপর তোমরা চিন্তা করে দেখ— তোমাদের সঙ্গী আদৌ পাগল নয়। তিনি তো কঠিন শাস্তি সম্পর্কে তোমাদের সতর্ককারী মাত্র।

এই আয়াতে আল্লাহ সম্মিলিত আলোচনার কথা বলেছেন। অর্থাৎ কাফেরদের বিনা চিন্তা-ভাবনায় নবীর অনুসরণ করতে হবে না। বরং তাঁর সম্পর্কে তারা চিন্তা করে দেখুক— তিনি কীসের আহ্বান জানাচ্ছেন? এতে তার লাভ কী? তিনি কী আসলেই পাগলদের মতো কিছু বলছেন? যদি তারা এককভাবে চিন্তা করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারে, তাহলে দুজন পরস্পর আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছুক। ড. গ্যারি নিজেই ‘সম্মিলিত আলোচনার প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে’ গবেষণা করেছিলেন। কোরআন পড়তে এসে দেখলেন— এ ব্যাপারে চৌদ্দশ বছর আগেই কথা বলা হয়েছে।

গ্যারি মিলারের চোখে আরেকটি বিস্ময় ছিল কোরআনের সুরা মারিয়াম। মারিয়াম (আ.) খ্রিষস্টধর্মে মাদার মেরি নামে সম্মানিত। বাইবেলে তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেল— তাঁকে সম্মানিত করার ক্ষেত্রে আল কোরআন বাইবেলকেও ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে আয়েশা এবং ফাতিমা (রা.)-এর নাম কোরআনে একবারও আসেনি, সেখানে মারিয়াম (আ.)-এর নামে স্বতন্ত্র একটি সুরাই নাজিল করা হয়েছে। যেখানে নবীজির নিজের নাম এসেছে মাত্র চারবার, সেখানে ঈসা (আ.)-এর নাম এসেছে ২৫ বার।

ড. গ্যারি মিলার সমকালীন ক্যাথলিক বিশ্বকোষ দেখেছেন। তাঁর মনে হয়েছে— কোরআনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এখানে আনা হয়েছে, তা যুক্তিতে টেকে না। চার্চ নিজেও এসব অভিযোগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, সাহস করেনি। আবার চিরন্তন সত্যও স্বীকার করেনি। এসবই হৃদয়ের চোখ খুলে দিয়েছে তার। এরপরই ইসলাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ একটি গ্রন্থই তাকে বদলে দেয় আপাদমস্তক। মুসলিম হওয়ার পর তার নাম হয় আবদুল আহাদ ওমর।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ