নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
মহান আল্লাহ মানব জীবনকে বিয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা দান করেন। এটা নির্মল জীবনযাপনের প্রথম স্তর। আত্মিক প্রশান্তি লাভের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। নবদম্পতির প্রথম রাতটি বাসর রাত হিসেবে সুপরিচিত। নারী-পুরুষ সবার জীবনে এ রাত খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম রাত থেকে স্বামী-স্ত্রী শরিয়তসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করলে গড়ে ওঠে পবিত্র ভালোবাসার স্থায়ী মজবুত বন্ধন। বাসর রাতের সংক্ষিপ্ত আমল নিচে তুলে ধরা হলো—
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা
দাম্পত্য জীবন আল্লাহর দেয়া সেরা একটি নিয়ামত। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের সহায়ক ও পরিপূরক। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা তোমাদের আবরণ এবং তোমরা তাদের আবরণ।’ (সুরা বাকারা: ১৮৭)
বাসর রাতে স্বামীর মুস্তাহাব আমল হলো স্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা। পরিপাটি নতুন মানুষটির সামনে নিজেকে আকর্ষণীয় রূপে উপস্থাপন করা। ছেড়ে আসা আত্মীয়-স্বজনের অভাব বুঝতে না দেয়া। প্রিয়তমাকে কিছু উপহার দেয়া। অন্তত দুধ, মিষ্টি ও শরবত ইত্যাদি একত্রে খাওয়া। এ সম্পর্কে হাদিস এসেছে। আসমা বিনতে উমাইস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ছিলাম আয়েশা (রা.)-এর বান্ধবী। আমি আরও কিছু মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে তাকে রাসুল (সা.)-এর জন্য প্রস্তুত করে দিয়েছি এবং তাঁর ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছি।
আসমা বলেন, আল্লাহ শপথ আমরা তার ঘরে মেহমানদারি হিসেবে এক পেয়ালা দুধ ছাড়া আর কিছু পাইনি। তিনি সে পেয়ালা থেকে কিছুটা পান করলেন। এরপর আয়েশা (রা.)-কে দিলেন। অল্প বয়সী মেয়েটি লজ্জাবোধ করল। তখন আমরা বললাম, আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর হাত ফিরিয়ে দিও না। গ্রহণ করো। তখন সে ইতস্তত করে হাতে নিল এবং সেটা থেকে পান করল। অতপর রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার বান্ধবীদেরকে দাও।’ আমরা বললাম, আমাদের চাহিদা নেই। তিনি বললেন, ‘তোমরা ক্ষুধা ও মিথ্যা দুটোকে একত্র করো না।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২৬৯২৫) ইমাম আহমদ (রহ.)-এর সূত্রে আদাবুয যিফাফ গ্রন্থেও হাদিসটি বর্ধিত আকারে উল্লেখ করা হয়েছে।
নববধূর মাথায় হাত রেখে দোয়া করা
বাসর রাতে বা তার আগে স্বামী-স্ত্রীর মাথার সম্মুখভাগে হাত রাখা, আল্লাহর নাম নেয়া, অতপর হাদিসে বর্ণিত বরকতের দোয়া করা। আমর বিন শুয়াইব (রহ.) তার পিতা থেকে দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো নারীকে বিবাহ করবে অথবা সেবক ক্রয় করবে, সে যেন তার কপালে হাত রেখে বিসমিল্লাহ পড়ে অতপর বলে, আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খইরহা, ওয়া খইর মাজাবালতাহা আলাইহি, ওয়া আউজুবিকা মিন শাররিহা, ওয়া শাররি মা জাবালতাহা আলাইহি। (আবু দাউদ : ২১৬০)
নবদম্পতির একত্রে নামাজ পড়া
বাসর রাতে নবদম্পতির প্রধান একটি আমল হলো একত্রে নামাজ করা। এটা মুস্তাহাব। সাহাবা ও তাবেয়ি থেকে এ আমল প্রমাণিত। এ সম্পর্কে দুটো হাদিসের মধ্যে একটি এরকম— শাকিক (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি আগমন করল, তাকে আবু হারীয বলে ডাকা হত। তারপর তিনি বলেন, নিশ্চয় আমি একজন যুবতি কুমারী মহিলাকে বিবাহ করেছি। আর আমি ভয় করছি যে, সে আমাকে অসন্তুষ্ট করবে। তারপর আবদুল্লাহ অর্থাৎ ইবনে মাসউদ বললেন, নিশ্চয় বন্ধুত্ব ভালোবাসা আল্লাহর পক্ষ থেকে আর রাগ অসন্তুষ্টি শয়তানের পক্ষ থেকে। শয়তান ইচ্ছা করছে যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা বৈধ করেছেন তা সে তোমাদের নিকট ঘৃণা সৃষ্টি করবে। সুতরাং সে যখন তোমার কাছে আসবে তখন তাকে জামাত সহকারে তোমার পেছনে দু’রাকাত নামাজ পড়তে নির্দেশ দেবে। তারপর দোয়া করবে।
ইবনু মাসউদ (রা.)-এর অন্য বর্ণনায় একটু বৃদ্ধি আছে। তিনি বলেছেন, তুমি বল, ‘হে আল্লাহ! আমার জন্য আমার পরিবারে বরকত দান করুন এবং তাদের স্বার্থে আমার মাঝে বরকত দিন। হে আল্লাহ! আপনি যা ভালো একত্রিত করেছেন তা আমাদের মাঝে একত্রিত করুন। আর যখন কল্যাণের দিকে বিচ্ছেদ করবেন তখন আমাদের মাঝে বিচ্ছেদ করুন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ১৭১৫৬, মুজামুল কাবির: ৮৯০০, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৭৫৪৭)
মিলন সম্পর্কিত বিধিনিষেধ
জৈবিক চাহিদা প্রত্যেকটি মাখলুকের মধ্যে আছে। সবাই সবার নির্ধারিত পদ্ধতিতে সেটা পূরণ করে থাকে। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত হওয়ায় তাদের জৈবিক চাহিদার পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র হওয়ারই দাবিদার। হাদিসে এসেছে সহবাসের আগে রাসুল (সা.) এই দোয়াটি পাঠ করতে বলেছেন, বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শাইতনা ওয়া জান্নিবনাশ শাইতনা মা রজাকতানা। (বুখারি: ১৪১,৩২৭১) দোয়াটি পাঠ করার বড় পুরস্কার হলো যদি এ সহবাস দ্বারা আল্লাহ তায়ালা ওই নবদম্পতিকে কোনো সন্তান দান করেন তাহলে শয়তান সন্তানের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। (আবু দাউদ: ২১৫৮)
সহবাসের সময় স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধামতো পদ্ধতি নির্বাচন করা। এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, মুহাম্মদ ইবনে আল মুনকাদির (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি জাবের (রা.)-কে বলতে শুনেছি, ইহুদিরা বলত যখন কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে পশ্চাদ দিক থেকে তার যৌনাঙ্গে সহবাস করে তখন যে সন্তান জন্মগ্রহণ করে সে টেরা হয়। তখন আল্লাহ তায়ালা এ আয়াত নাজিল করেন, তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য খেতস্বরূপ। কাজেই তোমরা তোমাদের ক্ষেত্রে যে রূপে ইচ্ছে সে রূপে গিয়ে ফসল উৎপাদন কর। (সুরা বাকারা: ২২৩) (আবু দাউদ: ২১৬০)
এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ইহুদিদের ভ্রান্ত মতবাদের অসারতা প্রমাণ করে দিয়েছেন। স্ত্রীর পায়ুপথে সহবাস করা হারাম। এ অপরাধের ভয়াবহতা সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ (কেয়ামতের দিন) ওই ব্যক্তির দেবেন না, যে তার স্ত্রীর পায়ুপথে সহবাস করে। (ইবনে মাজাহ: ৬৩৯) হাদিসে আরও কঠোর বার্তা এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর পশ্চাদদ্বারে সহবাস করে সে অভিশপ্ত।’ (আবু দাউদ: ২১৫৯)
পাশ্চাত্যের অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ব্লু ফিল্মের প্রভাব যেন মুসলিম সমাজে প্রবেশ না করে সেদিকে নবদম্পতির সতর্ক অবস্থানে থাকা উচিত।
সহবাসের মধ্যে অজু ও গোসল করা
একবার স্ত্রী সহবাসের পর পুনরায় স্ত্রী সহবাসের পূর্বে অজু করা উত্তম। আবু দাউদের ২২০ নম্বর হাদিসে এ বিধান দেয়া হয়েছে। হাদিসে আরও এসেছে, আম্মার ইবনে ইয়াসির থেকে বর্ণিত। নবীজি (সা.) অপবিত্র অবস্থায় পানাহার ও ঘুমানোর পূর্বে অজু করা বা না করার স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। আলী ইবনে আবু তালেব, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ও আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, অপবিত্র অবস্থায় কেউ কিছু আহার করতে চাইলে অজু করে নেবে। (আবু দাউদ: ২২৫) আর সহবাসজনিত অপবিত্রতার গোসল দ্রুত করা উত্তম। এটা অধিক পবিত্রতার বড় মাধ্যম। আত্মিক প্রশান্তি লাভের বড় উপকরণ। তবে বিলম্বে গোসল করা জায়েজ।
গুদাইফ ইবনে হারিস (রহ.) থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করি যে, রাসুল (সা.) অপবিত্র হওয়ার পর রাতের প্রথমাংশে গোসল করতেন না শেষাংশে? তিনি বলেন, তিনি কখনও রাতের প্রথমাংশে এবং কখনও শেষাংশে গোসল করতেন। তখন আমি খুশিতে বলি, আল্লাহ মহান, সমস্ত প্রশংসা তারই, যিনি এ কাজের জন্য প্রচুর সুযোগ রেখেছেন। (আবু দাউদ : ২২৬)
একান্ত বিষয়গুলো গোপন রাখা
ইসলামে মানুষের দোষ ত্রুটি প্রকাশ করে বিব্রত অবস্থায় ফেলা নিষেধ। স্বামী-স্ত্রীর একান্ত বিষয়ে অন্যের কাছে প্রকাশ করা ঠিক নয়। অন্যায় কাজ। যারা গোপনীয় বিষয়গুলো প্রকাশ করে বেড়ায় তাদের সম্পর্কে আবু দাউদের ২১৭১ নম্বর দীর্ঘ বর্ণনায় নবীজি (সা.) তাদেরকে প্রকাশ্য শয়তাদের কর্মকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে ভয়ঙ্কর পরিণতির বর্ণনা এসেছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম মানুষ হবে ওই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সঙ্গে মিলিত হয়। অতপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়।’ (মুসলিম: ৩৪৩৪)
দাম্পত্য জীবনে কোনো সমস্যা দেখা দিলে বিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া এবং শরিয়াতের বিধিবিধান জানার জন্য বিজ্ঞ আলেমদের দ্বারস্থ হওয়া নবদম্পতিদের জন্য একান্ত জরুরি।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ