নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
কে ভাবতে পেরেছিল অন্তরপুরবাসিনী আটপৌরে এক নারীর সঙ্গে ভোটযুদ্ধে হেরে যাবেন আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান লিডার। কিন্তু গণরায়ে তেমনটাই হয় আমরা সরল মনে যা না ভাবি। পরাজিত হয়ে আজমত উল্লা খান সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যিনি জয়ী হয়েছেন তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। পরাজিত হলেই ভোট ভালো হয়নি বলে নিন্দামন্দ করা হয়-এমন সংস্কৃতি থেকেও সবাইকে বের হতে বলেছেন তিনি। অন্যদিকে বিজয়ীর প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়ক পুত্র জাহাঙ্গীর আলম সবাইকে নিয়ে কাজ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এসবই সামগ্রিক গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক স্মারক। একসময়ের আওয়ামী লীগার এবং মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক এখন দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কৃত। দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত অমান্য করায় তিনি বহিষ্কারের মুখে পড়েছেন।
আব্রাহাম লিংকন আধুনিক গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘জনগণের সরকার জনগণের দ্বারা জনগণের জন্য।’ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গণতন্ত্রের জনক এরিস্টটল বলেছিলেন, গণতন্ত্র হচ্ছে গরিবতন্ত্র। যেখানে দারিদ্র্য সেখানেই অজ্ঞতা। তার গুরু প্লেটো গণতন্ত্রকে বলেছিলেন মূর্খতন্ত্র। গণতন্ত্র হচ্ছে মূর্খদের রাজত্ব। অধিকাংশ লোকই মূর্খ, গণতন্ত্রের উছিলায় এই মূর্খরাই রাজত্ব কায়েম করে। কিন্তু এই গণতন্ত্রের আবার বিরাট সৌন্দর্যও আছে। পুত্র বিপাকে পড়লে মায়েরাও এখানে নগরের শাসক হয়ে ওঠেন।
জাহাঙ্গীর আলম জানতেন ঋণসংক্রান্ত ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি আপত্তি থাকায় তার প্রার্থীতা বাতিল হতে পারে। এ কারণে নির্বাচনী রণক্ষেত্রে তার মাকে নিয়ে বাজি ধরেছিলেন। এবং প্রথম বাজিতেই ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। দেশে প্রথমবারের মতো পরপর দুই মেয়াদে ছেলে ও মা কোনো সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হলেন।
জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। তার এত অর্থ সম্পত্তি কোথা থেকে এল কিংবা তিনি চারিধারে এত অঢেল টাকা বিলিয়ে দেন কীভাবে? দুর্নীতির দায় নিয়ে দুদকের মামলার মুখেও আছেন তিনি। সমালোচনা একদম নিতে পারেন না, স্তাবকগোষ্ঠী পরিবেষ্টিত থাকতে খুব পছন্দ করেন। কিন্তু মহানগরে জনপ্রিয়তায় এখনও জাহাঙ্গীর অদ্বিতীয় এ কথায় কারো দ্বিমত থাকতে পারে না। গণরায়ই সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে।
নিজের জন্য যখন গণভোট গ্রহণ করতে পারেননি। তখন মাকেই রেখেছেন নিজের হয়ে পরীক্ষাটা দিয়ে দিতে। এবং বয়োজ্যেষ্ঠ মা তার ছেলেকে প্রমাণ করে দিয়েছেন। আমরা হয়ত অনেক কথা বলতে পারব -জায়েদা খাতুনের কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই, এমন কি সরবভাবে কোনো সোশ্যাল ওয়ার্কের সঙ্গেও জড়িত নন তিনি। এমন মা নগর সামলাবেন কীভাবে? এর উত্তর একটাই এই বয়সে মাসব্যাপী দিনরাত এক করে যে মানুষটি ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে তাদের ভালোবাসা পেতে চেয়েছেন এবং দু’হাত ভরে মানুষের মায়া কুড়িয়েছেন; যেটি নিজের জন্য নয়, কেবলি আত্মজাকে সঠিক প্রমাণ করবার জন্য এমন ত্যাগী ও প্যাশোনেট মাকে স্যালুট না জানিয়ে পারবেন না।
মায়ের যোগ্যতা অযোগ্যতা দিয়ে নগরের উন্নয়ন বা অবনমন হবে না। সরকারের সদিচ্ছা এবং অধিকার সচেতন নাগরিকের শুদ্ধ চাওয়া যখন একসূত্রে গ্রন্থিত হবে, কেবল তখনই হয়ত নগরের ভালো হতে পারে। খুব সিম্পল, নির্বাচক গোষ্ঠী যেমন হবে তাদের শাসকও তদ্রুপ হবে। আমরা বরং এই বিশ্বাসটা রাখি, যে অন্তরপুরবাসিনী নারী তার ছেলের মঙ্গলে অবগুণ্ঠন ভেঙে জনতার কাতারে নামতে পারেন তিনি নগরও সামাল দিতে পারবেন।
মায়ের আঁচলপাতা গণতন্ত্রের যে ছবকটি নিয়ে জাহাঙ্গীর আলম হাজির হলেন আমরা এই নবতর সংযোজনটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করি। স্ত্রী, দারা, পুত্র, স্বজন আপনাকে ছেড়ে যেতে পারে, মা জননী আপনাকে ছাড়বে না। এই অবিচ্ছেদ্য বন্ধনটির বন্দনা না করাটা হবে চরম অমানুষিকতা।
আগেই বলেছি সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের অনেক সমালোচনা আছে। সেই সমালোচকদের অনেকেই আছেন যারা তার নিমকও চেখেছেন। জাহাঙ্গীরের সিঞ্চিত জলে কতজনের বাগানের বৃক্ষরাজি যে প্রাণ পেয়ে চলেছে রোজ তার হিসাব মেলা ভার। জাহাঙ্গীর আলম দীর্ঘসময় বর্তমান সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ও মহানগর কমিটির রাজনীতি সার্ভ করেছেন। তাহলে সমালোচনাযোগ্য জাহাঙ্গীর আলমের দায়টুকু সবার আগে কার ওপর বর্তায়? দলীয় কমান্ড না মানার ঔদ্ধত্য কাদের আশকারার ফল? সেই বিবেচনা না করে ঢালাওভাবে একজন ব্যক্তির সমালোচনা করে যে, তাকে বাতিল করে দেয়া যায় না, গণবিচ্ছিন্ন করা যায় না -তার প্রমাণ ২৫ মে ২০২৩। আপনি একজনকে নৈতিক মানদণ্ড না চিনিয়ে কেবল একপাক্ষিক আদর সোহাগের ছত্রছায়া দিয়ে পেলে পুষে বড় করবেন, তারপর বিগড়ে গেলে বলবেন তুমি বাতিল, ত্যাজ্য করে দিলাম এটা হয় না।
সবার আগে রাজনীতিকে অগণন অর্থ আর দুর্বৃত্তায়নের কবল থেকে মুক্ত করতে হবে। জাহাঙ্গীরের জলে স্নানকারীদের বিশুদ্ধতার পাঠ গ্রহণ করতে হবে, তারপর করতে হবে অনুজদের সমালোচনা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগ ওঠায় প্রথমবার জাহাঙ্গীর আলমকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ওই বিষয়ে ২৪ নভেম্বর ২০২১ তারিখে প্রথম আলোতে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মহানগর সভাপতি আজমত উল্লা খান।
তিনি বলেছিলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলমকে যখন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তখন থেকে আওয়ামী পরিবারের কেউ তার সঙ্গে নেই। তার অতীত দিনের কার্যকলাপে দেখা গেছে, তিনি দলে থেকেও এর বাইরে একটি বলয় তৈরি করেছিলেন। এটা তিনি করেছিলেন জাহাঙ্গীর ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে। এই জাহাঙ্গীর ফাউন্ডেশনে যারা ছিল, তাদের অধিকাংশের ব্যাকগ্রাউন্ড ছাত্রশিবির বা জামায়াত বা বিএনপি। তাদের নিয়েই তিনি একটি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।’ জাহাঙ্গীরের প্রভাবের পেছনে জামায়াত শিবির ছিল। যে কারণে মহানগর সেক্রেটারি হওয়ায় দলের অনেকের আপত্তি ছিল। এমনটাই বলেছিলেন সভাপতি।
তারপর আমরা কী দেখলাম জাহাঙ্গীরকে দলের সদস্যপদ ফিরিয়ে দেয়া হলো। যার বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উত্থাপিত হলো তাকেই কিনা আবার আওয়ামী লীগের লোক বানানো হলো। এটা কেন হলো? আমরা জানি আওয়ামী নেতৃত্ব এই উত্তর দিতে পারবে না! সত্যকে সবার আগে প্রমাণিত হতে হয়। আধাআধি বা অনুমানযোগ্য সত্য বলে কিছু নেই। জাহাঙ্গীর আলম যদি শিবির ঘরাণার লোক হয় থাকেন, তাহলে তিনি এতটা দিন ধরে আওয়ামী লীগ কীভাবে করতে পারলেন? আসল গলদটা তবে কার? জাহাঙ্গীরের নাকি মিস্টার জাহাঙ্গীরকে যারা আদরের বস্তু বানিয়ে রেখেছিলেন তাদের? আসল শিবিরের তকমা কাদের গায়ে লাগল এই সবিশেষ প্রশ্নটি আওয়ামী হাইকমান্ডের কাছে রেখে গেলাম।
ফুটনোটস : এডভোকেট আজমত উল্লা খানের নিজের জ্যেষ্ঠ সন্তানের চেয়েও বয়সে ছোট একজন ছেলে, যিনি কিনা আবার একই রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে তারই ডেপুটি হিসেবে কাজ করেছেন এমন ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে জিতে যাওয়াটা যেমন গৌরবের নয়, তেমনি পরাজিত হওয়াটাও মাত্রাধিক গ্লানিকর। রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বা অন্য কারোরই এমন পরিস্থিতি তৈরি করা উচিত নয়। জুনিয়রের কাছে সিনিয়রের কিংবা অগ্রজের কাছে অনুজের সম্মান সুসংহত থাকবে এটাই নৈতিকতা হওয়া উচিত।
জাহাঙ্গীর আলম, জায়েদা খাতুন এবং অগ্রজ আজমত উল্লা খানের সমন্বিত অংশগ্রহণে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন একটি ফেয়ার এবং ফ্রি ইলেকশন উপহার দিতে পারল। এটা জাতীয় নির্বাচনে নিশ্চয়ই তাদেরকে যথাচিত পথ দেখাবে। মায়ের আঁচলপাতা গণতন্ত্রের আপাতত এটাই বড় সান্ত্বনা।
লেখক : সাংবাদিক
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ