ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৩, ২০ আশ্বিন ১৪৩০, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

চীনের ভূতুড়ে শহর!

প্রকাশনার সময়: ২৬ জুলাই ২০২৩, ১১:২৮

চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লিয়াওনিং প্রদেশের রাজধানী শেনিয়াংয়ের একটি শহরতলী এলাকা। সেখানে দেখা যাবে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য অর্ধনির্মিত ভিলা, যেগুলো একসময় মাল্টিমিলিয়নিয়ার কথা ভেবে নির্মাণ শুরু করা হয়েছিল। এই পরিত্যক্ত, ভূতুড়ে শহর এখন হয়ে উঠেছে কৃষকদের ফসল উৎপাদন এবং গবাদি পশুপালনের জায়গা। চীনা প্রপার্টি জায়ান্ট গ্রিনল্যান্ড গ্রুপ ২০১০ সালের দিকে শেনিয়াংয়ের শহরতলীতে স্টেট গেস্ট ম্যানসনস নামের একটি প্রকল্প শুরু করেছিল।

নগরীর অতি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের জন্য এই অঞ্চলটিতে ইউরোপিয়ান স্টাইলে ২৬০টি ভিলা বানানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু দুই বছর পর এ প্রকল্পটি বাদ দিয়ে দেয়া হয়। অর্ধনির্মিত এ ভিলাগুলো এখন স্থানীয় কৃষকরা দখল করেছেন। তারা এই বাড়িগুলোর সামনের লনের জমি চাষ করে ফসল বুনেছেন। অসমাপ্ত ভবনগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় যেন, খাঁ-খাঁ বিরান ভূমির মধ্যে সমাধিপ্রস্তরের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কিছু ইট-পাথরের স্থাপনা। এই ভূতুড়ে শহরে এখন কোনো মাল্টিমিলিয়নিয়ার থাকেন না, বরং এখানে জায়গা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের গবাদি পশুর, যেগুলো চরে বেড়াচ্ছে ইউরোপিয়ান-স্টাইলের অর্ধনির্মিত ভিলাজুড়ে! ভবনগুলোর ভেতরে প্রবেশ করলেও মনে হয় যেন ধ্বংসযজ্ঞের পরবর্তী অবস্থা, যেন ‘দ্য লাস্ট অব আস’ এর কোনো দৃশ্য।

বাড়ির মডেল থেকে বোঝা যায়, এ ভবনগুলো হওয়ার কথা ছিল চীনের নব্য-ধনীদের জন্য এক স্বর্গ, কিন্তু এখানে পরিত্যক্ত সম্পত্তির অন্ধকার গলিঘুপচি ছাড়া আর কিছুই নেই। এই ভূতুড়ে শহরে নিজের গবাদি পশু পালন করেন ৪৫ বছর বয়সি কৃষক গুয়ো। তিনি বলেন, অফিসিয়াল দুর্নীতির কারণে এই বাড়িগুলোর নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তারা অর্থায়ন থামিয়ে দেয় এবং অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, ফলে এই বাড়িগুলোর কাজ আর শেষ হয়নি। এই বাড়িগুলো হয়তো মিলিয়ন মিলিয়নে বিক্রি হতো, কিন্তু কোনো বিত্তবান ব্যক্তিই একটা বাড়িও কেনেননি’, বলেন গুয়ো। চীনের এই ভূতুড়ে শহর দেশটির সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘ওয়েইবো’ (অনেকটা টুইটারের মতো) ব্যবহারকারীদের কারও কারও নজরে পড়েছে। তাদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কেনো সরকার এ জমি অধিগ্রহণের জন্য বা এখানে কিছু করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

একজন ওয়েইবো ইউজার লিখেছেন, ‘এতবছর ধরে এই জায়গাটা পরিত্যক্ত পড়ে আছে।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘এখানে শুধু ভূতই থাকতে পারে!’ শেনিয়াং এর ভূতুড়ে ভিলাগুলো চীনের শহরাঞ্চলে বহু ‘ব্যর্থ’ রিয়েল-এস্টেট প্রকল্পেরই একটি। চীনের অনেক জায়গায়ই পরিত্যক্ত ভবন দেখা যায়। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে সংকটের মুখোমুখি হওয়ার পর চীনের রিয়েল এস্টেট জায়ান্ট এভারগ্রান্ড বহু প্রকল্পের নির্মাণকাজ থামিয়ে দিয়েছিল। এতে চীনা সরকারের মধ্যে ভীতি তৈরি হয় যে বড় আকারের প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়বে যা শহরের বিশাল জমি দখল করে রেখেছে।

২০২১ সালের অক্টোবরে এভারগ্রান্ড ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত কোম্পানি এবং বর্তমানে তাদের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ রয়েছে। আর শুধু এভারগ্রান্ডের কারণেই যে চীনের রিয়েল-এস্টেট প্রজেক্টগুলোর নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তা নয়। যারা চীনে রিয়েল এস্টেট ক্রয় করছেন বা নিজেদের প্রথম বাড়ি কিনছেন, তাদেরও এখনও নিজেদের স্বপ্ন ‘পরিত্যক্ত বাড়ি’তে পরিণত হতে দেখার ঝুঁকি রয়েছে; যেগুলোর কাজ কিনা মাঝপথে এসে বন্ধ হয়ে যায়।

ডুইন নামক সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে (টিকটকের চীনা সংস্করণ) এই পরিত্যক্ত ভবনগুলোতে বসে থাকা প্রচুর মানুষের ভিডিও রয়েছে। কোনো কোনো ভিডিওতে দেখা গেছে, লোকজন এই অর্ধনির্মিত বাড়িগুলোতে বিছানাপত্তর নিয়ে থাকছেন এবং অস্থায়ী রান্নাঘর বানিয়ে সেখানে রান্না করছেন। যখন গণহারে প্রচুর ভবন এভাবে পরিত্যক্ত হয়ে যায়, যেমনটা শেনিয়াং এর স্টেট গেস্ট ম্যানসনসের ক্ষেত্রে হয়েছে; তখন এই মেগা-উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পুরোপুরি ভূতুড়ে অঞ্চল বা ভূতুড়ে শহরে পরিণত হতে পারে।

টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক লি গান ২০২১ সালে অক্টোবরে ইনসাইডারকে বলেছিলেন, ‘ভূতুড়ে শহর’ চীনের একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। কম চাহিদা, কিন্তু জোগান অত্যন্ত বেশি থাকায় যে অসামঞ্জস্য তৈরি হয়, চীনজুড়ে গজিয়ে ওঠা এই পরিত্যক্ত ভবনগুলো তারই ফলাফল। অধ্যাপক লি গান বলেন, ‘অতিরিক্ত সরবরাহ থেকে এই ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে এবং পরে তারা এগুলো বিক্রি করে দিয়েছে। সেজন্যেই ফাঁকা পড়ে থাকে।’

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ