ঢাকা, বুধবার, ৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৯ আশ্বিন ১৪৩০, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

ফ্রুটভ্যালির দুঃখ ঘুচাল সাতছড়ি 

প্রকাশনার সময়: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৯:৫৮ | আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০:৫৫
সুরমা চা বাগানে লেখক।

কথা ছিল হবিগঞ্জ ফ্রুটভ্যালিতে গাছ দেখা, গাছ চেনা, আর ঘোরাঘুরি করে আনন্দময় একটি দিন উপভোগ করা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বাগড়ায় শেষ মুহূর্তে তা হয়ে ওঠেনি। আয়োজকদের তরিৎ তৎপরতায় সিদ্ধান্ত হলো ফ্রুটভ্যালির পরিবর্তে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে হবে ঘোরাঘুরি। অনেকে মন ক্ষুণ্ন হলেও ভয় জাগানিয়া বন ও চোখ জুড়ানো চা বাগান দেখার লোভে ফ্রুটভ্যালি ভ্রমণের কথা ভুলে সাতছড়ি ভ্রমণ মেনে নিলেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। তখনও পুরোপুরি আলো ফোটেনি। ফজরের আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তার রেশ তখনও রয়ে গেছে চারদিকে। আকাশে সাদা কালো মেঘের ওড়াউড়ি। এ রকম মনোরম শরৎসকালে এক-দুজন করে হাজির হচ্ছিলেন জাতীয় জাদুঘরের সামনে। সেখানে দুটি টুরিস্ট বাস নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন প্রকৃতিবিষয়ক লেখক জাহিদ রুম্মান। নির্ধারিত সময়ের ৫৫ মিনিট পর অর্থাৎ সকাল ৬টা ৫৫ মিনিটে যাত্রা শুরু হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের অভিমুখে।

তরুপল্লবের আভিযাত্রিক দলের কেউ কেউ বাসা থেকে অল্পস্বল্প খেয়ে এসেছেন। আবার কেউ কেউ কিছুই খাননি। এ আভিযাত্রিক দলের জন্য একজন প্রতিনিধি নাস্তা বানিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন নরসিংদীর পাঁচদোনায়। যথাসময়ে সেখান থেকে নাস্তা সংগ্রহ করে ফের শুরু যাত্রা। বাসের মধ্যেই নাস্তা সারতে সারতে ছুটছিলাম আর চারদিকে নানা দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। বাসের ব্লটুথে বাজছিল বাংলা-ইংলিশ হিন্দি গান। আমরা যখন সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে পৌঁছালাম, তখন স্বাগত জানাল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। অথচ গেল কয়েকদিন সেখানে কোনো বৃষ্টিও দেখা ছিল না।

উদ্যানের মূল ফটকে পৌঁছেই ফটোসেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমরা। ঘড়ির কাঁটা সোয়া ১২টার ঘরে, তখন মাউথ মাইকে মোকারম হোসেন ভাইয়ের ঘোষণা ধরে শুরু হলো মূল সফর অর্থাৎ সাতছড়ি অভয়ারণ্য ভ্রমণ। সেই ভ্রমণ চলল সোয়া ৩টা পর্যন্ত। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান সবার কাছে তেমন একটা পরিচিত না হলেও হবিগঞ্জবাসীর কাছে বেশ পরিচিত নাম। চুনারুঘাট উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড়ে এ উদ্যানটি অবস্থিত। এটি দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক উদ্যান। ১৯৭৪ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (সংশোধন) আইনের বলে ২৪৩ হেক্টর এলাকা নিয়ে ২০০৫ সালে পাহাড়ি উদ্যান প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ উদ্যানে রয়েছে সাতটি পাহাড়ি ছড়া। সেই থেকে এর নামকরণ সাতছড়ি। এ সাতছড়ির আগের নাম ছিল ‘রঘুনন্দন হিল রিজার্ভ ফরেস্ট’। যদিও ছড়িগুলোর যৌবন নেই। অর্থাৎ মরা ছড়ি। বিন্দুমাত্র পানি দেখা মিলল না ছড়িগুলোতে। তবে এক সময় এ ছড়িগুলোতে যে পানি প্রবাহমান ছিল তা বোঝাই যাচ্ছিল। বিশেষ করে বালিয়াড়িতে পা দিতেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে যাচ্ছিল। ঘুরতে ঘুরতে দেখা গেল নানা প্রজাতির পাখ-পাখালি। দিনদুপুরেই দূর থেকে শোনা বন্যপ্রাণীর তর্জন-গর্জন। ঘোরাঘুরির শেষ বেলায় দেখা মিলল চশমা পরা বানরে। বৃহৎ গাছের মগডালে বসে আভিযাত্রিক দলকে দেখছিল বানরটি। সঙ্গে থাকা গাইড জানালেন প্রায়শ মগডালে আয়েশ করে বসে থাকে চশমা পর বানর। এরা সাধারণ আক্রমণ করে না। কিন্তু বিরক্ত করে খেপে যায়। তাই ভ্রমণের সময় তাদের বিরক্ত না করাই উত্তম।

প্রতিষ্ঠার ১৮ বছরের পর ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বিশেষ করে যারা প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য পছন্দ করেন তাদের কাছে প্রিয় স্থান হয়ে উঠেছে এ উদ্যানটি। সাতছড়ি উদ্যানের কাছাকাছি ৯টি চা বাগান রয়েছে। পশ্চিম দিকে সাতছড়ি চা বাগান এবং পূর্ব দিকে চাকলাপুঞ্জি চা বাগান অবস্থিত। টিপরাপাড়া নামে একটি গ্রাম উদ্যানটির ভেতরে অবস্থিত। যেখানে ২৪টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার বসবাস করে। আশপাশের ১৪টি গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে চা বাগানের শ্রমিক ও বনের মধ্যে বসবাসকারীরা বিভিন্নভাবে বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। এ উদ্যানে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে। কারণ এখানে সহজেই আসা যায়। উদ্যানের গভীর অরণ্যে দেখা মিলবে বিচিত্র সব প্রাণী। পাশেই তেলিয়াপাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ।

‘তরুপল্লব’-এর ব্যানারে ঢাকা থেকে ৬৫ জনের দল ভ্রমণ দলের একজন ফারাহ হাসান মৌটুসি বলেন, ‘বনে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ বেশি। আর যদি হয় একেবারে বন্য তাহলে তো কথা নেই। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের কথা শুনেছি অনেক আগেই। ঢাকা থেকে এসে একেবারে বন্য পরিবেশে ভ্রমণ খুবই ভালো লেগেছে। এখানে এসেছে বনের পাশাপাশি চা বাগান ঘুরে মনটা আরও ভালো লেগেছে। কিন্তু চা কিনতে না পারায় মন কিছুটা খুব খারাপ লেগেছে।’

১৯১২ সালে প্রায় ১০ হাজার একর দুর্গম পাহাড়ি জমি নিয়ে গঠিত রঘুনন্দন হিলস রিজার্ভ কালের পরিক্রমায় আজকের সাতছড়ি উদ্যান। অবশ্য জাতীয় উদ্যান হওয়ার ইতিহাস বেশি দিনের নয়। ২০০৫ সালে ৬০০ একর জমিতে জাতীয় উদ্যান করা হয়। উদ্যানে দুই শতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে শাল, সেগুন, আগর, গর্জন, চাপালিশ, পাম, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, ডুমুর, জাম, জামরুল, সিধা জারুল, আওয়াল, মালেকাস, আকাশমনি, বাঁশ, বেত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

১৯৭ প্রজাতির জীবজন্তুর মধ্যে প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর। রয়েছে প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখ-পাখালি। লজ্জাবতী বানর, উল্লুক, চশমা পরা হনুমান, শিয়াল, কুলু বানর, মেছোবাঘ, মায়া হরিণের বিচরণ। সরীসৃপের মধ্যে আছে কয়েক জাতের সাপ। কাও ধনেশ, বন মোরগ, লাল মাথা ট্রগন, কাঠঠোকরা, ময়না, ভিমরাজ, শ্যামা, ঝুঁটিপাঙ্গা, শালিক, হলদে পাখি, টিয়া প্রভৃতির আবাসস্থল এ উদ্যান।