ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৩, ২০ আশ্বিন ১৪৩০, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

নজর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে

প্রকাশনার সময়: ২৪ আগস্ট ২০২৩, ০৭:১২

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অস্বাভাবিক লেনদেন হচ্ছে। এ ধরনের অন্তত এক লাখ মোবাইল ফোন নাম্বার শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। নাম্বারগুলোতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, মালায়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীদের পাশাপাশি দেশে বসেও টাকা পাঠানো হচ্ছে।

বেশিরভাগ নাম্বার বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে রেজিস্ট্রেশন থাকার কারণে ধারণা করা হচ্ছে ওইসব টাকা বিএনপির চলমান আন্দোলনে খরচ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কিছু ব্যক্তিকে দ্রুতই আইনের আওতায় আনা হতে পারে বলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বেশকিছু নাম্বারে হন্ডিতে টাকা পাঠানো হচ্ছে বলে জানানো হয়। এরপর সিআইডির পক্ষ থেকে তা তদন্ত করে দেখা যায় ওই টাকাগুলো যাচ্ছে বিএনপির জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে। পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতারাও ওই টাকা পাচ্ছেন। এ কারণে ধারণা করা হচ্ছে টাকাগুলো চলমান আন্দোলনে ব্যবহার হচ্ছে।

তিনি বলেন, বিদেশ থেকে আসা টাকাগুলো আসছে হন্ডির মাধ্যেমে। একই সঙ্গে দেশে বসেও এজেন্ট নাম্বার থেকে টাকা দেয়া হচ্ছে। ফলে গ্রাহকের সন্ধান পাওয়া গেলেও প্রেরক থাকছেন ধরা-ছোয়ার বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে টাকা উত্তোলন ও প্রেরকের এনআইডি নাম্বার সংগ্রহ করতে অপরেটরদের বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে। যদিও আগে থেকেই এ নিয়ম চালু ছিল। কিন্তু অনেক অপারেটর এ আইন মানছে না। এ কারণে এজেন্ট নাম্বারধারী গ্রাহককেও আইনের আওতায় আনা হতে পারে। এর আগে রেমিট্যান্সের টাকা হন্ডিতে আসায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরপর অনেকে সচেতন হলেও আবারও পুরোনো চেহারায় ফিরে গেছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ থেকে সিআইডিকে ৮ হাজার নাম্বারের তালিকা দেয়া হয়। পরে সিআইডির পক্ষ থেকে তদন্ত করতে গিয়ে এর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যায়। সেখানে দেখা গেছে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে গত দুই মাসে। দেশ ছাড়াও ওইসব নাম্বরে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীরা টাকা পাঠাচ্ছেন। নাম্বারগুলোর বেশিরভাগই বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়ের নামে রেজিস্ট্রেশন করা। এতে প্রবাসীদের অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে আসছে না। ফলে রমিট্যান্স হারাচ্ছে সরকার। আবার সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডেও টাকাগুলো ব্যবহার হচ্ছে।

জানা গেছে, এসব নম্বরের মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশ বা তার বেশি শুধু ‘ক্যাশ ইন’ হয়েছে। এবং মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশের বেশি ‘ক্যাশ আউট’ হয়েছে। প্রতি মিনিটে চারটি বা তার বেশি ‘ক্যাশ ইন’ হয়েছে রাত ২টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে। এ টাকাগুলো পাঠানো হয়েছে বিদেশ থেকে। এ ছাড়া দেশ থেকেও পাঠানো টাকাগুলো বিকাল থেকে রাত ৮টাকার মধ্যে ক্যাশ ইন ও আউট করা হয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, টাকাগুলো বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যয় হয়েছে। কারণ এর আগেও অভিযোগ উঠেছিল টাকার বিনিময়ে বিএনপি তাদের অনুষ্ঠানে লোকভাড়া করে আনছে। একইসঙ্গে ঢাকার বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীদের আসা-যাওয়া ও থাক-খাওয়ার পেছনে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ টাকাগুলো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যেমে পাঠানো হয়েছে বলে তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিএনপির কর্মসূচির আগের দু-একদিনে এসব নাম্বারে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য রয়েছে। বাকি সময়গুলোতে লেনদেনের তথ্য নেই।

জানা গেছে, বিদেশ থেকে টাকা পঠাতে হুন্ডি কারবারিরা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিয়েছে। কিছু অসাধু এজেন্ট এ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে প্রবাসে বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসার পরিমাণ কমে গেছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্তে নামে বিএফআইইউ।

সূত্রমতে, প্রবাসীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন এমএফএস প্রতিষ্ঠানের নামে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করছে একটি চক্র। হুন্ডি চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশি এজেন্টের কাছে অ্যাপ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবাসীদের সুবিধাভোগীর এমএফএস অ্যাকাউন্ট নম্বর ও টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে এসএমএস পাঠাচ্ছে। এখানকার এজেন্ট সুবিধাভোগীর নম্বরে ক্যাশ ইন করে দিচ্ছে। এতে করে প্রবাসীদের অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে আসছে না। বিষয়টি অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসার পর বিদেশে অবস্থানরত এমএফএস প্রতিষ্ঠনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ।

অন্যদিকে, অনলাইন গেমিং, বেটিং, ক্রিপ্টোট্রেডিং বা অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে এমএফএস এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় কিছু অসাধু এমএফএস এজেন্টের কাছে এসে ‘ক্যাশ আউট’ করে খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে ওইসব অনলাইন সাইটের পরিচালনাকারীদের কাছে পাচার হচ্ছে। এ ধরনের বেশিরভাগ সাইট ভারত ও চীন থেকে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের সহযোগিতা করছে দেশের মোবাইল ব্যাংকিংগুলো।

এ বিষয়ে নগদের হেড অব কমিউনিকেশন মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম সজল বলেন, ডিজিটাল হুন্ডির বিরুদ্ধে সব সময় স্বোচ্চার রয়েছে নগদ। সর্বোচ্চ সতর্কতার মাধ্যমে যে কোনো সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিরোধে আমরা বদ্ধপরিকর। লেনদেনে অস্বাভাবিকতা পাওয়া গেলেই সঙ্গে সঙ্গে বিএফআইইউতে সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং (এসটিআর) করা হয়।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সন্দেহভাজন লেনদেনগুলো বেশিরভাগই ঘটেছে গভীর রাতে। এবং ক্যাশ আউট হয়েছে দিনের বেলায়। সাধারণত প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে (এমএফএস) বেছে নিয়েছে। আর ওই প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা পাঠানোর জন্য গভীর রাতকে বেছে নিয়েছে। তারা টাকা পাঠানোর পর সুবিধামতো সময়ে গ্রাহক তার টাকা তুলে নিয়েছেন। আর এ কারণে সম্প্রতি রাত ১২টার পর টাকা লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংগুলো। তবে ব্যক্তিগত নাম্বারে টাকা লেনদেন স্বাভাবিক রয়েছে। রাতে ব্যক্তিগত নাম্বারে অস্বাভাবিক লেনদেন চোখে পড়তে তাৎক্ষণিক তা জানানোর জন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যুক্তদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সিআইডির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএফআইইউর কাছ থেকে তালিকা পাওয়ার পর তারা মাঠে নেমে সত্যতা পান। এরপর অনেককেই ডেকে পাঠানো হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে নামে এজেন্টশিপ দেয়া হয়েছে তার কোনো অস্বিত্ব নেই। সাধারণত একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এজেন্ট দেয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে মুরগি ব্যবসায়ীর কাছেও এজেন্ট নাম্বারের অস্বিত্ব পাওয়া গেছে। এ কারণে সবাইকে আইনের আওতায় আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। এক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত জেলা পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তারাও রয়েছে সিআইডির নজরদারিতে।

নয়াশতাব্দী/এমটি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ