নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
এক বছরের বেশি সময় ধরে হুমকিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডলার সংকটে কমছে রিজার্ভ। দর ঠিক রাখতে ডলার বিক্রির রেকর্ড গড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতেও নিয়ন্ত্রণের বাইরে ডলারের দর। এছাড়া প্রবাসী আয় যে পরিমাণে আসার কথা— তা আসছে না। যার বেশিরভাগই হুন্ডির পেটে। বিদেশে শ্রমিক যাওয়া বাড়লেও বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসা কমেছে। ব্যাংকিং চ্যালেনের থেকে হুন্ডিতে ডলারের দাম বেশি পাচ্ছে প্রবাসীরা। ফলে তারা হুন্ডিকেই বেছে নিয়েছে। এতে করে খোলাবাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। একই সঙ্গে চাহিদা ও দাম বেড়েছে। কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
জানা গেছে, খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম এখন ১২০ টাকা। যদিও ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রতি ডলারের বিপরীতে প্রবাসীরা প্রণোদনাসহ সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ২৪ পয়সা পাচ্ছেন।
গত দুই বছর ধরে ক্রমাগতভাবে কমছে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বর্তমানে দেশের ব্যবহারযোগ্য বা নেট রিজার্ভের পরিমাণ ২১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪৮.০৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এরপর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলের যে ধারাবাহিক পতন শুরু হয়, তা আর কোনোভাবেই ঠেকানো যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য বাংলাদেশের হিসেবে রিজার্ভ এখন ২৭.৬২ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবি— ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্সের বিপরীতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজের ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে ব্যাংক হিসাব পরিচালনায়ও অর্থ খরচ হচ্ছে। এতে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ এখনও সর্বোচ্চ পৌঁছেছে। যে কারণে রেমিট্যান্সের একটি অংশ সার্ভিস চার্জ হিসাবে চলে যাচ্ছে। এতে প্রবাসীদের লোকসান হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অবৈধ হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে প্রবাসীদের অনেকেই। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমছে। হুন্ডিতে ডলারের দাম বেশি পাওয়ার কারণে হুন্ডির জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যাদের মাসিক আয় কম এবং যারা অবৈধ অভিবাসী তারা হুন্ডিতেই টাকা পাঠাতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন।
অবৈধ হুন্ডির পাশাপাশি অনেকেই ঘরে ডলার কিনে রেখেছেন। ডলারের ক্রমবর্ধমান দামও ভবিষ্যতে আরও বাড়বে এ আশায় ব্যাংকে নিম্ন সুদহারের কারণে টাকা ব্যাংকে না রেখে ডলারে সঞ্চয় করছেন। অনেকে অবৈধ এমটিএফইর মতো অনলাইন বিজনেস করে হুন্ডির আশ্রয় নিচ্ছে। অনেকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করতে ফি দিতেও হুন্ডির মাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছেন। এর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমেছে। এ কারণে ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৬ লাখ ১৮ হাজার শ্রমিক। আর গত বছর শ্রমিক গেছেন রেকর্ড পরিমাণ ১১ লাখ ৩৬ হাজার। শ্রমিক যাওয়া এভাবে বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই রেমিট্যান্স বাড়ার কথা। কিন্তু হুন্ডির কারণে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাচ্ছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দামের কোনো মিল নেই। এ কারণে অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে বা হুন্ডিতে রেমিট্যান্স বাড়ছে। আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে প্রবাসী আয় বাড়াতে হলে বাজারদর অনুযায়ী ডলারের বিনিময় হার ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, খোলাবাজার ও নির্ধারণ করা দামের মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। এ অবস্থা যত দিন চলবে, তত দিন আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে আসা প্রবাসী আয় বাড়বে না।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারের দর বাজারভিত্তিক না করার কারণে রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ অবৈধ হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকগুলো যে দর দিচ্ছে হুন্ডিওয়ালারা তার চেয়ে বেশি দামে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। যে কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডি চ্যানেল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তিনি উল্লেখ করেন, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক রপ্তানি বেড়েছে। অথচ রেমিট্যান্স বাড়ছে না। বিশ্বব্যাংকের এক বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে দর এক শতাংশ বেশি হলেই সাড়ে ৩ শতাংশ রেমিট্যান্স হুন্ডিতে চলে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, হুন্ডি বন্ধের বছর তথা ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়, রিজার্ভও সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এ স্ফীতির প্রধান কারণ করোনা মহামারির সময় হুন্ডি ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়েছিল। করোনা চলে যাওয়ার পরের অর্থবছরে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠানো আবার চাঙা হয়ে ওঠে। তখন বৈধপথে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলএও) জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট রেমিট্যান্সের ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। বাকি ৬০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ নগদ আকারে ও বাকি ৩০ শতাংশ হুন্ডির মাধ্যমে। নগদ আকারে আসা রেমিট্যান্সের প্রায় পুরোটাই হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হয়।
এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার ব্যক্তিগত গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, রেমিট্যান্সের ৪২ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে। বাকি ৫৮ শতাংশ আসে ব্যাংকের মাধ্যমে। সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নানও শিকার করেছেন হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স বেশি আসছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে প্রবাসীরা চলতি মাসের প্রথম ৭ দিনে ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। এ হিসাবে প্রতিদিন রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে ৫ কোটি ২৭ লাখ ডলার। যদিও জুলাইয়ের প্রথম তিন সপ্তাহে দৈনিক রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে পৌনে ৭ কোটি ডলার করে। তার আগের মাস জুনে প্রবাসীরা প্রতিদিন পাঠিয়েছিলেন গড়ে ৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলার করে। ওই মাসে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর সদ্য বিদায়ী আগস্ট মাসে প্রবাসীরা দেশে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ গত মাসে প্রতিদিন গড়ে ৫ কোটি ১৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে আগস্টে। খোলা মুদ্রাবাজারে ডলারের উচ্চদর থাকায় প্রবাসীদের হুন্ডির মাধ্যমে আয় পাঠানোই— এজন্য দায়ী বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগস্টে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ২১.৫৭ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের আগস্টে রেমিট্যান্স (বৈধ চ্যানেলে) এসেছিল প্রায় ২.০৪ বিলিয়ন ডলার। গত চার বছরের আগস্ট মাসের তুলনায় এ বছরের আগস্টেই সর্বনিম্ন পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি মাসের প্রথম ৭ দিনে ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৩ কোটি ২০ লাখ ৮০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত ব্যাংকের মাধ্যমে ৫৯ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার, বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ৩২ কোটি ৯১ লাখ ২০ হাজার ডলার ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ৬ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স, যা সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ৫৭ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। হুন্ডি বেড়ে যাওয়ার কারণে শুধু যে রিজার্ভের পতন হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়, ডলার সংকটে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না। বকেয়া আমদানির বিল পরিশোধ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আগে বিদেশ থেকে আসার পর অনেক ব্যক্তি আমাদের কাছে ডলার বিক্রি করতেন, বর্তমানে তারা আসেন না। রেমিট্যান্স আগের চেয়ে কমেছে। ফলে আগের চেয়ে ব্যাংকে অনেক কম ডলার আসছে। চাহিদা বাড়তে থাকলেও, ব্যাংকের কাছে ডলারের জোগান বাড়েনি। তাই ব্যাংকের পক্ষেও গ্রাহকের চাহিদামতো ডলার সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) খোলাবাজারে নগদ ডলারের দাম কমাতে গত ৩০ আগস্ট এক যৌথ অভিযান শুরু করে। এদিনে অভিযানে এক লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার, ৩০ হাজার কানাডীয় ডলার ও ৩৮ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে হুন্ডি ব্যবসায় জড়িত কয়েক জনকে। একইদিন বিশেষ পরিদর্শন শেষে আটটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আরও ১০ প্রতিষ্ঠানকে ডলার বাণিজ্যে অনিয়মের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্ধারিত দরের চেয়ে তারা বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে, এমনকি নিয়মিত তথ্য প্রদানও করেনি।
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ