নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
আশ্রয় শিবিরের নিরাপত্তা বেষ্টনী ডিঙিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং দ্রুত ধনী হতে হিংস্র হয়ে উঠছে শরণার্থীরা। জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে। তৈরি হচ্ছে অপরাধীদের গ্রুপ ও উপ-গ্রুপ। প্রায়ই সংঘাত হচ্ছে। ব্লকে ব্লকে মাদক, মানব পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসার কারণে দেশের মাদকের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর তৎপরতা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), ইসলামী মাহাজ ও জমিয়তুল মুজাহিদীনের সাংগঠনিক তৎপরতা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাধারণ ঘটনা। রোহিঙ্গা অপরাধীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় কিছু দালাল। এই দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট। শুধু তাই নয়, গহীন অরণ্যে গড়ে তুলেছে অপরাধের স্বর্গরাজ্য। মাদক ও অস্ত্র পাচারের মতো কাজে জড়িয়ে পড়ছে তারা। যা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরের বাইরে কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সেই পর্যন্ত যাওয়া সম্ভবই হয় না।
ইয়াবা ব্যবসা, মানবপাচার, অপহরণ, চাঁদাবাজি, হাটবাজার নিয়ন্ত্রণ রাখতে প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। সন্ধ্যা হলে ক্যাম্পের ভেতরে সন্ত্রাসীরা অস্ত্র নিয়ে নেমে পড়ে। পুরো ক্যাম্প তখন তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। নির্ধারিত হারে চাঁদা না দিলে অপহরণ, গুম, খুন প্রায়ই হচ্ছে ক্যাম্পগুলোতে।
সূত্র বলছে, ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া বন্ধে বসানো হয়েছে এপিবিএন পুলিশের চেকপোস্ট। কিন্তু অনেক সময় চেকপোস্টগুলোর শিথিলতার সুযোগে ফাঁকফোকর দিয়েও বের হচ্ছে রোহিঙ্গারা। একই সঙ্গে মেরিন ড্রাইভ কিংবা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে তুলে নেয়া হয়েছে অনেক চেকপোস্ট। স্থানীয়দের দাবি, ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ছয় মাসে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে ২৩ জন মাঝিসহ ৬০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এই খুনের মধ্যে ক্যাম্পের বাইরে থেকে অপহরণ করে নেওয়া ১১ জন স্থানীয় রয়েছে।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, গেল ৬ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা হয়নি। আর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো আশাও দেখছি না। এর কারণে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে যেভাবে বের হচ্ছে এটা খুবই আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয়। এটা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকির বলে মনে করছি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। এভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। তাই সরকার, প্রশাসন, সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যাওয়া বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক ও মেরিন ড্রাইভে চেকপোস্টগুলো সচল করে নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা নাহলে রোহিঙ্গারা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
তবে ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন বলছে, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের সমাজে মিশে যেতে দেওয়া যাবে না। সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তাদের কোনও নির্দিষ্ট স্থানে রাখার ব্যবস্থা করা দরকার। একইসঙ্গে তাদের একটি তালিকা তৈরি করে রাখা উচিৎ যাতে পরবর্তীতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজ হয়। রোহিঙ্গারা সমাজে মিশে গেলে নানা অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন অনুযায়ী দেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় রাখার ব্যবস্থা করা দরকার। বিশেষ করে এসব রোহিঙ্গা এখন যে ক্যাম্পগুলোতে রয়েছে, সেখান থেকে যাতে কোথাও যেতে না পারে সেজন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
কক্সবাজার সিটি কলেজের ট্যুরিজম অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মঈনুল হাসান চৌধুরী পলাশ বলেন, রোহিঙ্গা অপরাধীদের কারণে কক্সবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিষিয়ে উঠেছে। খুবই উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ক্যাম্প ছাড়াও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা শহরসহ জেলার অধিকাংশ খুনের সঙ্গে জড়িত। তাদের কারণে টেকনাফের পর্যটন স্পষ্টগুলো হুমকির মুখে। সেখানে নিয়মিত অপহরণ ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। রোহিঙ্গাদের পেশাদার অপরাধী আখ্যা দিয়ে তাদের অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আলাদা ব্যাটালিয়ন গঠনের দাবি জানান তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, ক্যাম্পে অপরাধীদের ধরতে এপিবিএনের পাশাপাশি জেলা পুলিশও কাজ করছে। অপরাধ দমনে সর্বদায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ রয়েছে।
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ