ঢাকা, সোমবার, ২৯ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ৮ জিলকদ ১৪৪৪

জাপায় মাইনাস ফর্মুলা

প্রকাশনার সময়: ২৬ মে ২০২৩, ০৭:০০ | আপডেট: ২৬ মে ২০২৩, ১২:০৭

সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) এখন ভাঙনের মুখে। এদিকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের গ্রুপ। অন্যদিকে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের গ্রুপ। তাদের বিরোধ-দ্বন্দ্ব প্রকট। সহসা মিট-মীমাংসাও হবে বলে মনে করছেন না দলটির নেতাকর্মীরা। আর এ দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের সুযোগে জাতীয় পার্টিতে উত্থান হয়েছে নতুন আরেকটি গ্রুপের। যারা জাতীয় পার্টিকে পরিবারতন্ত্রের ধারা থেকে বেরিয়ে নিয়ে আনতে নতুন ফর্মুলা নিয়ে এগোচ্ছেন। দলটির শীর্ষ দুই নেতাকে মাইনাস করতে চায়। এ লক্ষ্যে জাতীয় পার্টির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে বাড়ানো হচ্ছে যোগাযোগ। যাদের নেতৃত্বে রয়েছেন দুই গ্রুপের সাবেক মন্ত্রী, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক মহাসচিব। চমক দিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তারা সক্রিয় ভূমিকায় আবির্ভূত হতে পারেন। ‘নো জি এম কাদের, নো রওশন এরশাদ’— এমন আওয়াজ উচ্চারণ মধ্য দিয়ে আসতে পারে জাতীয় সম্মেলনে ঘোষণা। এ মতের সঙ্গে একাট্টা ঘোষণা করে যোগ দেবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ সারা দেশের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে আসতে পারে বড় ধরনের পরিবর্তন। দলীয় সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

দলটির মধ্যম সারির দুই নেতা বলছেন, জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ এখন রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের হাতে নেই। ঘর থেকেই পার্টির সবকিছু নির্ধারণ করে দেয়া হয়। জাপার শীর্ষ দুই নেতা রওশন ও জি এম কাদেরকে পরিচালনা করছেন অন্য কেউ। রওশন এরশাদকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়া হচ্ছে না। আর জি এম কাদেরের ঘরের লোক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন। যার কারণে পার্টিতে পল্লীবন্ধুর নাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে। পরিবারতন্ত্রের দলাদলির কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা প্রতিনিয়ত দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে রংপুর-চট্টগ্রামসহ সারা দেশের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নতুন নেতৃত্বে চাইছেন। জাতীয় সম্মেলনে তৃণমূলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এরশাদের সঙ্গে রাজনীতি করা দলের পোড় খাওয়া নেতারা নেতৃত্বে আসতে পারে।

অবশ্য তারা এও বলছেন, পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে রাজনীতি করা যোগ্য ব্যক্তি এখনো পার্টিতে রয়েছে। অথচ দল সঠিকভাবে মূল্যায়ন করছে না। সুযোগ থাকলেও তাদের দলের অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেয়া হচ্ছে। অনেককে ভিড়তেও দেয়া হচ্ছে না। কারণ তারা ভিড়লে অনেকে বাদ পড়তে পারেন।

জাপা সূত্রের দাবি, জি এম কাদেরকে চালাচ্ছেন তার স্ত্রী সংসদ সদস্য শেরিফা কাদের। তাকে নিয়ে দলের মধ্যে নানা বিতর্ক রয়েছে। আর রওশন এরশাদকে চালাচ্ছেন তার ছেলে রাহাগির আল মাহি সাদ এরশাদ ও পুত্রবধূ মাহিমা এরশাদ। এদের কেউ কেউ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও রওশন এরশাদ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও হতে চান। এদের হাতেই এখন জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ। অথচ পল্লীবন্ধু জীবিত থাকাকালে রওশন এরশাদ ছাড়া অন্যদের কোনো ক্ষমতা বা গ্রহণযোগ্যতা ছিল না জাতীয় পার্টিতে। রওশন এরশাদকে মানতে পারলেও অনেকে জি এম কাদের ও তার স্ত্রী শেরিফা কাদের, সাদ এরশাদ ও তার স্ত্রী মাহিমা এরশাদকে মানতে পারেন না। এদের কেউ কেউ মনোনয়ন ও দলীয় পদ-বাণিজ্যর সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে উদ্দেশ্যে প্রণীতভাবে জি এম কাদেরের নামের আগে ‘জনবন্ধু’ জুড়ে দেয়া হয়েছে। মূলত পল্লীবন্ধুর নাম মুছে ফেলার ষড়ষন্ত্র চলছে। আর রওশন এরশাদের গ্রুপ পল্লীবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে জি এম কাদের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরাতে চাইছেন। পরিবারতন্ত্রের ধারা থেকে জাতীয় পার্টিকে বের করে আনার নতুন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যার নেতৃত্বে থাকতে পারেন জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙাসহ জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতারা। এদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে রংপুরের শীর্ষ একাধিক নেতাসহ সিলেট-চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা। নতুন ফর্মুলা সম্পর্কে অবগত আছেন এমন একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া শতাব্দীকে বলেন, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিয়ে ক্লিন ইমেজের জাতীয় পার্টি গড়ার লক্ষ্য নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। যার মূল লক্ষ্য থাকবে পল্লীবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন। কোরবানির ঈদের পর পরই আসতে পারে বড় ধরনের পরিবর্তন। দলের পোড় ও ত্যাগী নেতাদের সমন্বয়ে আসতে পারে নতুন নেতৃত্বে ঘোষণা। তিনি আরও বলেন, কোরবানির ঈদের পর রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের ডাকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বড় একটা অংশ সাড়া দেবে না। পার্টির ভেতরে থাকা চিহ্নিত দালাল ও বিভিন্ন সময়ে যারা পার্টির ক্ষতি করেছেন তাদের দল থেকে বের করে দেয়ার দাবি তুলবে। প্রস্তাব যদি প্রত্যাখ্যান হয় তাহলে এরশাদের ছবি পোস্টারে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে ‘স্বতন্ত্র’ভাবে সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হবে। নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন কেউ কেউ। জানা গেছে, ওয়ান-ইলেভন সরকার আমলে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ একবার ভাঙন ধরাতে চেষ্টা করেছিলেন। সে সময়ে নিজেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দাবি করেছিলেন। রওশন এরশাদের দৃঢ়তার কারণে সে সময়ে ব্যর্থ হয়েছিল। আরেক নেতা মশিউর রহমান রাঙা রংপুরে বিএনপি করত এক সময়। পরে ২০০১ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। এছাড়াও সম্প্রতি বর্তমানে জি এম কাদেরের প্রতি পার্টি অফিস থেকে জুতা পেটা করে বের করে দেয়াসহ নানা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রাঙা। সূত্র জানায়, প্রেসিডেন্ট পার্কে বিদিশা এরশাদের প্রবেশ করার পেছনেও জি এম কাদেরের হাত রয়েছে। মূলত রওশন এরশাদকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাস্ট থেকে দূরে রাখতেই এ কৌশল নেয়। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের হয়তো আর কখনো এক টেবিলেও বসবেন না, চলমান সংকট সমাধানের চেষ্টাও করবেন না। তিনি কখনো জি এম কাদের কাছে পদ-পদবি চাবেন না। কারণ তিনি নিজেই বড় পদ। এ অবস্থায় দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান ও সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্যরা জাতীয় পার্টিকে নতুন কৌশলে ঐক্যবদ্ধ করতে চাইছেন।

জানতে চাইলে রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব ও দশম জাতীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসীহ্ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘নতুন ফর্মুলা নিয়ে কারা এগোচ্ছে, এটা আমার জানা নেই। আমাদের দিক থেকেও কেউ জড়িত রয়েছে বলে আমি মনে করছি না। নতুন ফর্মুলা নিয়ে কেউ এগোতে চাইলে অতীতের মতো এবারও ব্যর্থ হবে। দলের মধ্যে ভাঙন ধরাতে পারবে না।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের দলের কেউ মনোনয়ন বা পদ বাণিজ্য হচ্ছে— এটার সম্ভবনা একেবারেই জিরো। এমন তথ্যও আমার জানা নেই। এছাড়া এখনো মনোনয়ন দেয়া শুরুই করেননি রওশন এরশাদ।’

জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব সাইদুর রহমান টেপা নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘দলের কো-চেয়ারম্যান, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ সবাই জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। আমাদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে। দলের মধ্যে থেকে কেউ এই ধরনের হীন তৎপরতা করছে কিনা, এটা আমার জানা নেই।’ তিনি বলেন, ‘পাটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ আমাদের মাতৃতুল্য, তাকে আমরা অত্যন্ত সম্মান করি। দলের মধ্যে হয়তো কিছু মীর জাফর ও দুষ্কৃতকারী থাকতে পারে, যারা জাতীয় পার্টির কখনো ভালো চায় না। হয়তো আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নিক এটাও চাইছেন না। এজন্য এসব কথা রটাচ্ছে। কিন্তু তাদের কোন চেষ্টাই সফল হবে না।’ এ ব্যাপারে জাপা মহাসচিব মো. মজিবুল হক চুন্নুকে একাধিকবার মোবাইল ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

নয়া শতাব্দী/এফআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ