ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

রাজনীতিতে ‘গুজব’ আতঙ্ক

প্রকাশনার সময়: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩:৪২ | আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:১৫

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ২০১৮ সালে অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ তার ফেসবুক আইডি থেকে একটি লাইভে এসে বলেন, ‘আমি কাজী নওশাবা আহমেদ আপনাদের জানাতে চাই, একটু আগে জিগাতলায় আমাদেরই ছোট ভাইদের একজনের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে এবং দুজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। আপনারা সবাই এক সঙ্গে হোন। প্লিজ ওদের প্রটেকশন দেন। বাচ্চাগুলো আনসেভ অবস্থায় আছে। প্লিজ আপনারা রাস্তায় নামেন এবং ওদের প্রটেকশন দেন। যদি সরকার প্রটেকশন দিতে না পারে তাহলে আপনারা মা-বাবা হয়ে ভাইবোন হয়ে বাচ্চাগুলোকে প্রটেকশন দেন। এটা আমার রিকুয়েস্ট। আমি একজন এ দেশের মানুষ, এ দেশের নাগরিক হিসেবে আপনাদের কাছে রিকুয়েস্ট করছি যে, জিগাতলায় একটু আগে একটি স্কুলে একটি ছেলের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে এবং দুজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। ছাত্রলীগের ছেলেরা সেটা করেছে। প্লিজ প্লিজ ওদের বাঁচান।’

কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সেদিন জিগাতলায় এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরাও এ ধরনের কোনো ঘটনার প্রমাণ পায়নি। পরে অবশ্য নওশাবা তার লাইভটি মুছে দিয়েছেন। এছাড়াও আগস্ট মাসের শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তার সহধর্মিণীর নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি চেকের ছবি ছড়িয়ে পড়ে। চেকটিতে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা ফান্ড থেকে বিএনপির মহাসচিবকে ৫০ লাখ টাকার সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। ওই সময় বিএনপি মহাসচিব চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছিলেন। চেকটি দিয়ে প্রচার করা হয়, বিএনপি মহাসচিবকে প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্য সহায়তা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে মির্জা ফখরুল প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এমন সহায়তা নেননি। পুরো বিষয়টি ছিল গুজব। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ধর্মীয়, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বাহিনীর সদস্য, সেলিব্রিটি, মৃত্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব গুজবের কোনোটি দেশের ভিতর থেকে, আবার কোনোটি দেশের বাইরে থেকে ছড়ানো হয়। মূলত দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে এমন গুজব ছড়ানো হয় বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে গুজব ছড়ানো বৃদ্ধি পাচ্ছে। কখনও কখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাপিয়ে এসব গুজব স্থান পায় দেশের প্রথম শ্রেণির গণমাধ্যমেও। দেশে বর্তমানে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন বিষয়ে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ে কাজ করে ১১ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান হলো—‘রিউমার স্কানার বাংলাদেশ’। এ প্রতিষ্ঠানের হিসাব মতে, ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি গুজব শনাক্ত করে ২৩৯টি, ২০২২ সালে ১৪০০টি এবং ২০২৩ সালে আগস্ট পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ১০৮২টি ভুল তথ্য বা গুজব শনাক্ত করে। ২০২৩ সালে ছড়িয়ে পড়া গুজবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৪৮টি ছিল রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে। যা মোট ভুল তথ্য বা গুজবের ২৩ শতাংশ। গেল বছর এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৯২টি। ২০২২ সালে ধর্মীয় বিষয়ে গুজব ছিল ২০৬টি। রাজনীতিবিষয়ক ৯২টি, জাতীয় ইস্যুতে ১১৫টি, খেলাধুলা নিয়ে ১৫৬টি এবং শিক্ষা বিষয়ে ৩৮টি গুজব ছড়ানো হয়েছে। ছিল কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে ১১১টি। চলতি বছরের গেল আট মাসে আন্তর্জাতিক বিষয়ে ২২৯টি, খেলার বিষয়ে ১২৩টি, জাতীয় বিষয়ে ১১৬টি, ধর্মীয় বিষয়ে ১১১টি, শিক্ষা বিষয়ে ৮১টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে ৬৩টি, বিনোদন ও সাহিত্য বিষয়ে ৫০টি, আর্থিক প্রতারণা বিষয়ে ৪৪টি এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে ১৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।

প্রতিষ্ঠানটির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত আট মাসে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক (৪৩) ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে, যা মোট রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ১৭ শতাংশ। এছাড়া কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিরো আলমের বিষয়ে ২০টি, জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিষয়ে ১৫টি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বিষয়ে ১২টি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিষয়ে ১০টি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিষয়ে ৮টি, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুরের বিষয়ে ৭টি এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিষয়ে ৭টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ ফ্যাক্টচেকার সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনৈতিক বিষয়ক গুজবের পরিমাণ ততই বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেটে অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় রাজনৈতিক বিষয়ে অপতথ্য কয়েকগুণ বেশি ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে ইন্টারনেটে নিজ দলের পক্ষে ইতিবাচক প্রচারণার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নেতিবাচক তথ্য প্রচারের প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। এর ফলশ্রুতিতে ইতিবাচক প্রচারণা করতে গিয়ে অনেক সময় অতিরঞ্জিত ও বানোয়াট তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। অন্যদিকে, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা করতে গিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।’

এ ধরনের গুজব সাধারণ মানুষের পক্ষে ধরা সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘হ্যাঁ, সামান্য কিছু কৌশল অবলম্বন করলে সাধারণ মানুষ অনেক অপতথ্যের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। প্রচারিত তথ্যটি অতিরঞ্জিত মনে হলে সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতে হবে। নেটিজেনরা চাইলে তথ্যের উৎসের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতে পারে। তথ্যটি কী কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই প্রচার করা হয়েছে নাকি গণমাধ্যমেও এসেছে তা দেখতে হবে। গণমাধ্যমে এলেও সেখানে ওই তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য আছে কিনা সেটি দেখা প্রয়োজন। তথ্যটি যে উৎস থেকে প্রচার করা হচ্ছে, সেটি গ্রহণযোগ্য কিনা তা দেখতে হবে। তথ্যটি সামান্য নাম ও ঠিকানা পরিবর্তন করে মূলধারার গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটের আদলে তৈরি ভুঁইফোড় বা অখ্যাত অনলাইন পোর্টাল থেকে প্রচার করা হয়েছে কিনা তাও জানা প্রয়োজন। মূলধারার গণমাধ্যমের সূত্রে প্রচার করা হলেও তথ্যটি আদৌ সেই গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য গণমাধ্যমটির ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তথ্যটি কে বা কারা প্রচার করছে তাও দেখতে হবে। তথ্য প্রচারের পেছনে প্রচারকারীর ব্যক্তিগত, দলগত বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে, তাই তার বেকগ্রাউন্ডও জানা প্রয়োজন।

গুজব শনাক্তে ব্যয় কোটি টাকা: এদিকে এমন গুজব ঠেকাতে পুলিশের কয়েকটি বিশেষায়িত ইউনিটে সাইবার ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। একেকটি ল্যাব স্থাপনে খরচ হয়েছে ৮ কোটি থেকে ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বলে জানা গেছে। কেনা হয়েছে ডিজিটাল সরঞ্জাম। আরও সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। এ ছাড়া গুজব ছড়ানোর ঘটনায় গত প্রায় তিন বছরে শুধু রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন থানায় অন্তত ৯৮টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে রমনা মডেল থানায়। জানা গেছে, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) সাইবার ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করেছে। ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উত্তর ও দক্ষিণের জন্যও ল্যাব স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। সিআইডি রাজশাহী, খুলনা, রংপুরের পর সব বিভাগেই ফরেনসিক ল্যাব তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। র‍্যাবের ফরেনসিক ল্যাবের জন্য ২০১৮ সালের শেষ দিকে ১২৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা দেয়া হয়। ২০১৯ সালের মধ্যে র‍্যাব তাদের ল্যাব আধুনিকায়ন করে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সিটিটিসির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব পেয়েছে। ল্যাবে অপরাধী শনাক্ত করতে আধুনিক সব সরঞ্জাম স্থাপন করা হয়েছে। জঙ্গি প্রতিরোধের পাশাপাশি গুজব প্রতিরোধেও কাজ করছে সিটিটিসি। র‍্যাব ও সিআইডির ল্যাব সবচেয়ে আধুনিক।

পর্যাপ্ত নয় বিটিআরসির সক্ষমতা: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা গুজব ও মিথ্যা তথ্যের লিঙ্কগুলো সরিয়ে ফেলতে তালিকা দেয় বিটিআরসিকে। এরপর সেগুলো সরাতে বিটিআরসি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে অনুরোধ করে। তবে এসব ক্ষেত্রে ৩৫-৪০ শতাংশ লিঙ্ক সরানো হয়। বাকিগুলোকে মতামতের স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এড়িয়ে যায়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো না সরালে তেমন কিছু করার থাকে না বিটিআরসির। জানতে চাইলে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের এক অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার বলেন, ‘গুজব শনাক্তে আমরা কাজ করছি। তবে সমস্যা হলো, মানুষের নৈতিকতার অভাবে অধিকাংশ গুজবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়ানো হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অপরপক্ষের চরিত্র হননের জন্য এসব গুজব ছড়ানো হয়। বর্তমানে সবার হাতেই মোবাইল ফোন রয়েছে। কেউ চাইলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু একটা লিখে ছেড়ে দিতে পারছে। যে কারণে এটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করাও দুরূহ হয়েছে উঠেছে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। যেখানেই আমরা এ ধরনের অপরাধের অভিযোগ পাচ্ছি সেখানেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ