নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কাছে কদর বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের। কারণ আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মহল্লাহভিত্তিক এসব দলের সদস্যদের পেশিশক্তি হিসেবে পাশে চাচ্ছে সবাই। আর এ সুযোগে কিশোর গ্যাংয়ের দলনেতারা তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে নিয়মিত মহড়া দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তাদের নামে কত মামলা আছে এবং তাদের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে তৈরি করছেন বায়োডাটাও। গত কয়েকদিনে নয়া শতাব্দীর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বিস্তারিত। সেখানে দেখা গেছে কিশোর গ্যাংয়ের অন্তত ১৬ নেতার নামে রয়েছে খুনসহ শতাধিক মামলা। এমন পরিস্থিতিতে এসব নেতাদের সন্ধান করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশিদ জানান, পাড়া মহল্লাহভিত্তিক কিশোরগ্যাং নেতাদের তালিকা করা হচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে এক একজন গ্যাং নেতার নামে একাধিক মামলা রয়েছে। তারা আসন্ন নির্বাচনে নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতে যেন কোনো ধরনের অপকর্মে জড়াতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে কিছু নেতাদের ধরতে ডিবির অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
জানা গেছে, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে পেশিশক্তির মহড়া দেখাতে মরিয়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। প্রায়ই দু-দলের পক্ষ থেকে নিয়মিত মিছিল মিটিং ও সভা সমাবেশ করা হচ্ছে। সেখানে উঠতি বয়সি তরুণদের বেশি দেখা যাচ্ছে। যাদের অধিকাংশ কিশোর গ্যাংযের সঙ্গে জড়িত। টাকা বিনিময়ে তারা নিয়মিত এসব মিছিল ও সভা সমাবেশে যাচ্ছেন। নির্বাচনের আগে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যরা একটা ‘ফ্যাক্ট’ এটা প্রমাণ করতে এ গ্রুপের সদস্যরা পাড়া মহল্লায় নিয়মিত মহড়াও দিচ্ছেন। নিজের গুরুত্ব বোঝাতে তারা এখন সবাই একাট্টা। তাদের এমন কর্মকাণ্ড পর্যালচনা করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এমনকি এসব গ্যাং কালচারের পেছনে তারা কলকাঠি নাড়ছেন তারও সন্ধান করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট রাতে উত্তরখানের খ্রিস্টানপাড়া ডাক্তার বাড়ির মোড় এলাকায় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশার চাকা থেকে পানির ছিটা লাগে হৃদয় নামে এক কিশোরের গায়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রিকশাচালককে মারধর করে হৃদয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আরেক কিশোর সোহাগ মারধরের কারণ জানতে চায় হৃদয়ের কাছে। দুজনের মধ্যে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে হৃদয়কে চড় মারে সোহাগ। এতেই ঘটনা উল্টোদিকে মোড় নেয়। হৃদয় তার বন্ধুদের বিষয়টি জানালে তারা এসে সোহাগের কাছে মারধরের কারণ জানতে চায়। শুরু হয় তর্কাতর্কি। একপর্যায়ে হৃদয়ের বন্ধু মাহবুবুল ইসলাম ওরফে রাসেল ওরফে কাটার সোহাগের পেটে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় সোহাগকে উত্তরার একটি হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে দুই অপরাধীকে। তারা কিশোরগ্যাং লিডার হলেও বয়স এখন ২০ বছর। এরই মধ্যে তাদের নামে বিভিন্ন থানায় মামলার সংখ্যা ডজন ছাড়িয়েছে।
ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে প্রেমিকা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে হাতিরঝিলে কিশোর সন্ত্রাসীরা ছুরিকাঘাত করে শিপন হাসান (১৮) নামে এক কিশোরকে হত্যা, আরেক কিশোর মানিককে (১৮) আহত করে। এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত সবাই ছিল কিশোর। একই বছরের ৩০ আগস্ট পবিত্র আশুরার দিন সকালে এক বছর আগের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে খুন হয় কিশোর মুন্না। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ১৩ কিশোরসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এদের অনেকেই একন জাবিনে মুক্ত। এখন তাদের নামে প্রতিদিনই ছিনতাই, অপহরণের মতো গুরুতর অভিযোগ আসছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় এলাকাভিত্তিক কিশোর সন্ত্রাসীদের তালিকার কাজ। তালিকা করতে গিয়ে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে পড়ছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। শুধু উত্তরা এলাকায়ই এ ধরনের ১০টি গ্রুপের ১৬ জন নেতা রয়েছেন। তাদের এক একজনের নামেই খুনসহ সর্বোচ্চ ১২টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে। সর্বনিম্ন মামলার সংখ্যা ৬টি। এরা স্থানীয় নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় এতটা বেপরোয়া। কখনো কখনো পরিবারের সদস্যরাও তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রাজধানীর উত্তরখান থানা এলাকার সোহাগ হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করার পর দেখা গেছে, তাদের গ্রুপের নেতার বয়স একটু বেশি হলেও সদস্যরা সবাই কিশোর। এদের সবার নামেই একাধিক মামলা থাকলেও এলাকায় দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করে। পুলিশ ঘটনার বাইরে আরও কিছু ঘটনায় বিভিন্ন সময় শাকিল, সুমন, শাওন ও ছোটনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে একজনের নামে ১২টি মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে। এ গ্রুপের সদস্যদের তালিকা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে এদের পেছনে কারা ইন্ধন জোগাচ্ছে সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জানা গেছে, শুধু উত্তরা ও মিরপুরের বড়বাগ এলাকায় ১০টি কিশোরগ্যাং সক্রিয় রয়েছে। তার মধ্যে উত্তরার পাকুরিয়া এলাকার নাইন স্টার গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে তালা-চাবি রাজু। একই এলাকার ৭নং সেক্টরের সেভেন স্টার গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে জয় ও শাকিল। ১৪নং সেক্টরের ডিসকো বয়েজের নেতা সেতু। আব্দুল্লাপুর আইচি মেডিকেল এলাকায় শিকদার গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে মৃদুল ও একন। বড়বাগ এলাকা পিকে গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ করে কাওছার। আজমপুর কাঁচাবাজার এলাকায় চাপাতি সুমন গ্রুপের নিয়ন্ত্রক সুমন ও শুভ। দুধ শামিম গ্রুপের নামে আব্দুল্লাহপুর কোটবাড়ি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে শামিম ও সিফাত। আজমেরি বালুর মাঠ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে আলতাফ। তার গ্রুপটি নিজের নামেই গঠন করা হয়েছে। উত্তরা ১১নং সেক্টরে মামুন-শিরির গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে একটি গ্রুপ। উত্তরখান মাজার এলাকার নিয়ন্ত্রণ পরাগ ও সাকিবের হাতে। তাদের নামেই গ্রুপটি গঠন করা হয়। এদের মধ্যে ২০১৮ সালে উত্তরায় চাঞ্চল্যকর কিশোর আদনান হত্যাকাণ্ড জড়িয়ে পড়ে ডিসকো বয়েজ এবং নাইন স্টার গ্রুপ।
জানা গেছে, দক্ষিণখানের একটি কিশোর গ্রুপের নেতা মো. নাজমুল হুদা ওরফে নাদিম। তার নামে প্রথম মামলা দায়ের করা হয় ২০১৯ সালে। দক্ষিণখান থানায় এক বছরের ব্যবধানে তার নামে এখন মামলার সংখ্যা ৬টি। এর মধ্যে খুনের মামলাও রয়েছে। মামলা নম্বরগুলো হচ্ছে মামলা নং-২ তারিখ, পহেলা জুলাই, ২০১৯ সাল। এর আগের মাসে দায়ের করা মামলা নং-৬। একই মাসে দায়ের করা অপর মামলা নং-৬। এরপর ২০২০ সালের ১৭ জুন তার নামে আবারও একই থানায় দায়ের করা মামলা নং-১৩। এর আগের মাসের ১৩ তারিখে পুলিশের ওপর আক্রমণ মামলা নং ০৫। এসব ঘটনার পর সে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় খুন করে কিশোর সোহাগকে।
২০২০ সালের ২৮ আগস্ট দায়ের করা ১০নং মামলারও এজাহারভুক্ত আসামি। গোয়ালঘাট শাপলা মার্কেট এলাকার ২২ বছর বয়সি কিশোরগ্যাং লিডার মো. শাকিল ওরফে ড্যান্সার শাকিল। তার নামে এ পর্যন্ত ৮টি মামলার কথা জানা গেছে। ২০১৬ সালে তার নামে প্রথম মামলা হয়। তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। ২০১৬ সালে পহেলা জুলাই দক্ষিণখান থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা নং ০৩। এর পরের বছর উত্তরা পূর্ব থানায় ১৭ সেপ্টেম্বর দায়ের করা মামলা নং ০৭। চলতি বছরের ১৪ আগস্ট উত্তরখান থানায় দায়ের করা মামলা নং ০৪। ২০১৮ সালের পহেলা জানুয়ারি উত্তরখান থানায় দায়ের করা মামলা নং ১৩। চলতি বছরের ১৭ জুন দক্ষিণখান থানার মামলা নং ১৩। একই থানায় পর দিন দায়ের করা মামলা নং ১৫। একই থানায় ২০১৯ পহেলা জুলাই দায়ের করা মামলা নং ০২। এছাড়া দক্ষিণখান থানায় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা নং ০৫-এর আসামিও এই শাকিল ওরফে ড্যান্সার শাকিল। উত্তরখানের বড়বাগ মহিলা মার্কেট এলাকার ২১ বছর বয়সি বাসিন্দা মো. বাহাউদ্দিন হাসান শাওন ওরফে গ্রিল শাওন। কিশোর বয়সে যার অপরাধের হাতেখড়ি। এখন নিজেই কিশোর গ্যাং লিডার। তার নামে এ পর্যন্ত ৮টি মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রথম মামলা হয় ২০১৬ সালে। তখন তার বয়স ছিল ১৫ বছর।
মামলাগুলো হচ্ছে— উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা নং-২৭ (তারিখ ১২/০৯/২০১৮), একই থানায় মামলা নং ০৭ (তারিখ-০৬/০৬/২০১৭), দক্ষিণখান থানার মামলা নং-১৩ (তারিখ-১৭/০৬/২০২০), একই থানায় মামলা নং-০৬ (তারিখ-০৯/০৬/২০২০), উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা নং-০২ (তারিখ-১০/১২/১৬), উত্তরখান থানায় মামলা নং-০৫ (তারিখ-০৪/০৩/২০২০), একই থানায় মামলা নং-১৬ (তারিখ-২৪/০৩/২০১৯), দক্ষিণ খান থানায় মামলা নং-০৫ (তারিখ-১৩/০৫/২০২০)। বোর্ড বাজার এলাকার মো. আক্তারুজ্জাম ছোটন। বয়স ২০ বছর। ১৬ বছর বয়সে তার অপরাধে হাতেখড়ি। তার নামে উত্তরা এলাকার বিভিন্ন থানায় ১২টি মামলার সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনিও এখন কিশোর গ্যাং লিডার।
তার নামে উত্তরা পশ্চিম থানায় ৫টি মামলা রয়েছে। মামলাগুলো হচ্ছে— মামলা নং-২৭ (তারিখ ১২/০৯/২০১৮), মামলা নং-০২ (তারিখ-০১/০৭/২০১৯), মামলা নং-০৭ (তারিখ-০৬/০৬/২০১৭), মামলা নং-০৩ (তারিখ-১২/১০/১৬)। ছোটনের নামে দক্ষিণখান থানায় ৮টি মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। দক্ষিণখান থানার মামলা নং-০২ (তারিখ-০১/০৭/২০১৯), মামলা নং-০৬ (তারিখ- ০৮/০১/২০১৭), মামলা নং-০৬ (তারিখ-০৮/০১/১৭)। মামলা নং-০৬ (তারিখ-০৯/০৬/২০২০), মামলা নং-১৫ (তারিখ-১৮/০৬/২০২০), মামলা নং-১৩ (তারিখ-১৭/০৬/২০২০), মামলা নং-১৮ (৪)১৬), ২৩(০৮)১৬, মামলা নং-০৫ (তারিখ-১৩/০৫/২০২০)।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এসব গ্রুপের প্রতিটা দলেই ১৫ থেকে ২০ জন কিশোর সক্রিয় রয়েছে। এদের নেতার বয়স ২০ বছরের ওপরে হলেও সদস্যরা সবাই ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী। এ পর্যন্ত গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী অন্তত ১৮০ জন সদস্য শুধু উত্তরা এলাকাতেই সক্রিয় রয়েছে। তারা চুরি, ছিনতাই, মারামারি, আধিপত্য নিয়ে ছুরিকাঘাত, মাদক ব্যবসা, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় এমনকি খুন করতেও পিছপা হচ্ছে না। এসব নেতা অপরাধ কর্মকাণ্ডে পা দিয়েছিল কিশোর বয়সেই। বর্তমান তারা নির্বাচনের আগে আবারও মাথাচাড়া নিয়ে উঠেছে। এখন তারা নির্বাচনে পেশিশক্তি হিসাবে ব্যবহার হতে চাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কোন দলের পক্ষ নেবেন তা এখনই নিশ্চিত না করে সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রেখে দিচ্ছেন। পরিস্থিতি বুঝে তারা পক্ষ নেবেন বলে কয়েকজন লিডারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ