নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও নিয়ন্ত্রণ করছে আধা সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান! অবিশ্বাস্য হলেও এমনটাই চলছে। মশক নিবারণী দফতরটি যেন একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ দফতরে কর্মরত বেশিরভাগই ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনে দায়িত্ব পালন করছেন।
২৮ বছর ধরে মশক নিবারণী দফতরে কর্মরত এমন এক কর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শুরুতেই মশক নিবারণী দফতরকে অন্য প্রতিষ্ঠানের পেটে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও আমরা এখন আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে! দফতরটি প্রতি মাসে শুধু কর্মীদের বেতন-ভাতা তৈরি করছে। বসে বসে বেতন নেব— এমন চিন্তা থেকে কেউ কথা বলেনি। সিটি করপোরেশন কোড অনুযায়ী যে সাহায্য মঞ্জুরি খাত থেকে টাকা পায়, আমরাও সেখান থেকে পাই। ফলে সিটি করপোরেশন নিজেদের স্বার্থে এ দফতর ব্যবহার করছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার ম্যালেরিয়া নিরোধের লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার ‘মশক নিয়ন্ত্রণ স্কিম’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮০ সালে বিভাগটিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়। ১৯৮২ সালে এনাম কমিটি ৩৯৬টি পদ সৃজন করে এই দফতরের জনবল পুনর্বিন্যাস করে। কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় ‘ঢাকা মশক নিবারণী দফতর’। সেই থেকে প্রথমে পৌরসভা এবং পরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে রাজধানীর মশা নিধনে কাজ করে যাচ্ছে দফতরটি। এর জনবলকে পরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আত্মীকরণ করা হয়। তারাই এখন দুটি সিটি করপোরেশনের অধীনে রাজধানীর মশা নিধনে কাজ করছেন। দুই সিটি করপোরেশনের ২০টি অঞ্চলে সুপারভাইজাররা হেঁটে তদারকির কাজ করেন। ক্রুরা সিটি করপোরেশনের নিজস্ব স্প্রেম্যানদের সঙ্গে মিলে ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন। ঢাকা মশক নিবারণী দফতর সূত্রে জানা গেছে, মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সরকার ১৯৮০ সালে পুরান ঢাকার পলাশী এলাকায় এক একর ৩৯ শতাংশ জমির ওপর মশক নিবারণী দফতর চালু করে। দফতরটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। দফতরে মোট জনবল ছিল ৪১৭ জন। কিন্তু ১৯৮৪ সালে দফতরটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যায়। পরে জনবল কমিয়ে ৩৯৬ জন করা হয়। বর্তমানে ১৩৭টি পদ শূন্য রয়েছে। ঢাকা মশক নিবারণী দফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে মোহাম্মদ শামছুল ইসলাম (উপসচিব) অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর ম্যালেরিয়া মোকাবিলা করতে ঢাকায় মশা মারার কাজ হাতে নেয়া হয়েছিল। তখন সংস্থাটি বেশ জমজমাট ছিল। অনেক লোক কাজ করতেন। মশা নিয়ন্ত্রণে বেশ ভালো ভূমিকা পালন করতেন ওরা।’ তিনি জানান, মশক নিয়ন্ত্রণ স্কিমের আওতায় কন্টিনজেন্ট হিসেবে ৪১৭ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে এদের মধ্য থেকে ৩৩৮ জনকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেয়া হয়। এরপর মশা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে কিছু কাজ হয়।
জামাল উদ্দিন বলেন, ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুটি সিটির অধীনে রাখা হয়। এখন সংস্থটির জনবল ২৬৯ জন। এর মধ্যে ২৩১ জন ক্রু, ৩২ জন সুপারভাইজার ও ৬ জন ইনসেক্ট কালেক্টর (আইসি) রয়েছেন। এই জনবল অর্ধেক করে দুই সিটি করপোরেশনে ভাগ করে দেয়া হয়। তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হয় স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে। জানা গেছে, ১৯৮০ সালের আগে ‘মশক নিবারণী দফতরে’ একটি গবেষণাগার ছিল। নিয়মিত গবেষণা কার্যক্রমও চলত। এখন গবেষণাগারটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আধুনিকায়ন করে জনবল বাড়িয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। তাহলে সংস্থাটি শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের মশাবাহিত রোগ নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ঢাকা মশক নিবারণী দফতরের জনবল বাড়িয়ে ওষুধ কেনার নিজস্ব ক্ষমতাসহ কীট নিরোধে গবেষণা কার্যক্রম চালানোর সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। তাহলে প্রতিষ্ঠানটি মশা-নিধনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘মশক নিবারণী দফতর একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্গঠন করা যেতে পারে অথবা ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।’
জানা গেছে, পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার ২২/১/এ, নুর ফাতাহ লেন, ঢাকেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন ১ একর ৩৯ শতাংশ জমির মশক নিবারণী দফতরের জায়গার অনেকটাই বেদখল হয়ে গেছে। কর্মীরা জানান, দফতরের ২০ কাঠা জমি ঢাকা ওয়াসাকে দেয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরকে দেয়া হয়েছে ১৩ কাঠা জমি। স্থানীয় লোকজন ওরিয়ন্ট ক্লাব নামে একটি সংগঠনের ব্যানারেও কিছু জায়গা দখল করেছে। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী সংস্থার জায়গা দখল করে গ্যারেজ ও কারখানা গড়ে তুলেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অবশিষ্ট জমিতে একটি দোতলা ভবন তৈরি করা হয়েছে। অথচ বেদখল হওয়া জমির খাজনাও মেটায় মশক নিবারণী দফতর।
সূত্র জানায়, সংস্থাটির কার্যক্রম গতিশীল করতে ২০১০ সালের শেষ দিকে দুই কোটি ৯২ লাখ ২১ হাজার টাকা ব্যয়ে ছয়তলা ভবন নির্মাণকাজ শুরু করে গণপূর্ত অধিদফতর। চার বছর আগে ভবনটি নির্মিত হলেও লোকবলের অভাবে সেটি নির্জীব অবস্থায় পড়ে আছে। দফতরে কর্মরতরা জানান, এই দফতরটি মূলত ঢাকা শহর কেন্দ্রিক মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। তবে অধিদফতরে রূপান্তর করা হলে তারা সারা দেশে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে মনে করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দফতরটি মশা নিধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, ঢাকা সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে আসার পর থেকে যে কাজে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ হলো মশা নিধন করা। কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষমতা নেই। আমরা শুধু ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্দেশনা অনুযায়ী মশা মারার ওষুধ বিভিন্ন জোনে বিতরণ করি এবং এখানে ওষুধ মজুত করি। অর্থাৎ ভবনটি এখন গোডাউন হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।’ জানা গেছে, কলকাতার আদলে ‘ঢাকা মশক নিবারণী দফতর’কে একটি গবেষণাগার করা যায় কিনা এ নিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশন এরই মধ্যে কাজ করছে। অপরদিকে সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটি আধুনিকায়নের মাধ্যমে একে মশা নিধনে কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য তৈরির কথাও ভাবছে সরকার। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে বলে ‘কেন্দ্রীয় মশক নিবারণী দফতর’ নিয়ে পরিকল্পনা হচ্ছে। তবে আইনমতে, প্রত্যেক সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার দায়িত্ব মশা-নিধন। আগে যেহেতু স্থানীয় সরকারের এত প্রতিষ্ঠান ছিল না, তাই কেন্দ্রীয়ভাবে ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য ‘মশক নিবারণী দফতর’ সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন আইনের মধ্যে বলা আছে, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা মশা নিধন করবে। সুতরাং এখন এটা নিয়ে করণীয় নির্ধারণে কমিটি করে দেয়া হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট পেলেই পরবর্তী কার্যক্রম নেয়া হবে।’ তবে এর সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের অন্যান্য বিষয় জড়িত। মশক নিবারণী দফতরটির পরিধি কতটুকু বাড়ানো হবে, কাদের সঙ্গে এটির সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং এটি মন্ত্রণালয় বা সিটি করপোরেশন কোনটির অধীনে থাকবে সেসব নির্ধারণের বিষয় রয়েছে। সিটি করপোরেশনের অধীনে চলে এলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কোন খাত থেকে আসবে সে সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত হতে হবে। তাই বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন বলে জানান হেলালুদ্দীন আহমদ।
মশা নিধনে গবেষণার জন্য একটি আধুনিক গবেষণাগার তৈরির পরিকল্পনার উল্লেখ করে সচিব বলেন, ‘কলকাতার আদলে একটি গবেষণাগার করা যায় কিনা এ নিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশন এরই মধ্যে কাজ করছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই সিটি করপোরেশনের কাজের আওতার মধ্যে চলে গেছে মশক নিবারণী দফতর। এ কারণে সংস্থাটিকে মশা নিধন, সচেতনতা এবং মশাবিষয়ক গবেষণার কাজে ব্যবহার করার সুযোগ নেই। দফতরটি অনেক আগে থেকেই সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। এটি নিয়ে এখন বলার কিছু নাই। তবে লোকবল বৃদ্ধি করে মশক নিধনের কাজ বেগবান করার চিন্তা করছে কর্তৃপক্ষ।
নয়া শতাব্দী/এফআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ