নয়া শতাব্দী অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি।
সংগীতাঙ্গনজুড়ে চলছে মাদকের ভয়াবহ র্যাকেট। এ চক্রের সদস্যরা উঠতি বয়সি গায়কদের মাদকে আসক্ত করে তুলছে। তারা মদ-ইয়াবা-গাজা-আইস ও এলএসডির মতো ভয়ঙ্কর সব মাদকের সাপ্লায়ার বলে তদন্তে ওঠে আসছে। বিনিময়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা।
এ ছাড়া ‘গান গাইতে গেলেই নেশা করা লাগবে’ এমন ভাবনা থেকেও অনেকে মাদকে জড়াচ্ছেন। সম্প্রতি মাদককাণ্ড ও টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার গায়ক মাইনুল আহসান নোবেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে চাঞ্চল্যকর এ র্যাকেটের তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার দেয়া তথ্যমতে— চক্রের অন্তত দুই ডজন সদস্যকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যে কোনো সময় তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, নোবেল যাদের কাছ থেকে মাদকে পেতেন তাদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে শিল্পীও রয়েছেন। আরও কিছু সদস্য আছেন যারা উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীদের মাদকে আসক্ত করার জন্য কাজ করেন।
বিনিময়ে তারা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। কারণ পাবলিক ফিগার হওয়ার কারণে অনেক তারকা নিজে মাদক কেনা থেকে দূরে থাকেন। এ সুযোগে চক্রের সদস্যরা তাদের কাছে মাদক পৌঁছে দেন। যাচাই-বাছাই শেষে চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে ডিবির একাধিক টিম কাজ করছে। তদন্ত ও গ্রেফতারের স্বার্থে এখনই নামগুলো প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
ডিবি প্রধান বলেন, নোবেল মাতাল হয়ে নানা কাণ্ড ঘটানোর জন্য এখন অনুতপ্ত। তিনি নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করবেন বলে কথা দিয়েছে। তার বিষয়ে তার সাবেক স্ত্রীরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। সেখানে তিনি নোবেলকে মাদকাসক্ত করার পেছনে কয়েকজনের নাম বলেছেন। এর মধ্যে একজন বিমানবালাও রয়েছেন। এ বিষয়গুলোও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৯ সালে ভারতের জি-বাংলা টিভির রিয়েলিটি শো ‘সা রে গা মা পা’তে অংশ নিয়ে তৃতীয় হয়ে আলোচনায় উঠে আসেন নোবেল। তবে জনপ্রিয়তার সঙ্গে নানা কর্মকাণ্ডে বিতর্কিতও হন উঠতি এই গায়ক। এর মধ্যে তার স্ত্রীও তার মাদকাসক্তির কথা প্রকাশ করেন এবং তার সঙ্গে সংসার জীবনের ইতি টানেন। এরই মাঝে গেলো শুক্রবার মতিঝিল থানায় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তার নামে এক ব্যক্তি মামলা করেন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়- শরীয়তপুরের একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে অর্থ নিয়েও সেখানে না যাওয়া। ওই মামলায় শনিবার নোবেলকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একদিনের রিমান্ডে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ। যদিও কিছু টাকা পরিশোধ করার পর সোমবার আদালত তাকে জামিন দেন।
এর আগে গ্রেফতারের পর রোববার গোয়েন্দা প্রধান হারুন-অর-রশিদ তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সঙ্গদোষে মাদকাসক্ত হয়েছেন নোবেল। তবে এখন তা ছেড়ে দিতে চান। কার কার মাধ্যমে মাদকাসক্ত হয়েছেন, এটাও তিনি বলেছেন।
এই মাদকাসক্ত হওয়ার কারণেই তিনি কোনো প্রোগ্রাম রাখতে পারেন না। আর প্রোগ্রামে গেলে মাতাল হয়ে যান। এটা তিনি স্বীকার করেছেন। সম্প্রতি নোবেল কুড়িগ্রামে এক অনুষ্ঠানে গাইতে গিয়ে মঞ্চে অসংলগ্ন আচরণ করে শ্রোতা-দর্শকদের রোষের মুখে পড়েছিলেন।
তিনি বলেন, নোবেল অনেক নাম বলেছে। কিন্তু এগুলো বলতে চাচ্ছি না। তার মতো শিল্পী, তার অনেক এজেন্ট আছে, নিজেও সংগ্রহ করেন মাদক। শিল্পী অনেক আছেন তারাও মাদকাসক্ত। তাদের ব্যাপারেও অভিযান চালান হবে এবং আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গ্রেফতারের পর শনিবার নোবেলের সাবেক স্ত্রী সালসাবিল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, মাদকাসক্তিই তার সাবেক স্বামীর মূল সমস্যা। কোনো একটা চক্রের মধ্যে পড়ে সে নেশাটা শুরু করে। এরপর সে প্রচণ্ড মাদকাসক্ত হয়ে যায়। এরপর তার ব্যবহারে চেঞ্জ আসে এবং সে অন্য একটা অন্য মানুষে পরিণত হয়। নোবেলের আশপাশে থাকা একটি চক্র তাকে মাদক সরবরাহ করছে বলে দাবি করেন সালসাবিল।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নোবেল ছাড়াও আরও অনেক উঠতি বয়সি শিল্পি মাদকাসক্ত বলে তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের মাদক সাপ্লাইয়ের পেছনে একটি শক্তিশালী র্যাকেট কাজ করে। ওই চক্রে একটি মহানগরের যুবলীগ নেতা, কয়েকজন নায়িকা ও কলা-কুশলি রয়েছেন। তারাও নিয়মিত মাদক সেবন করেন। একই সঙ্গে উঠতি বয়সি শিল্পীদের মাদকাসক্ত করতে ইন্ধন জোগান। তালিকায় দু’একজন সাংবাদিকও রয়েছেন বলে গোয়েন্দা পুলিশের বিস্বস্ত সূত্র দাবি করেছে। তাদের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, মাদকের এ র্যাকেটে নাম আসছে হেভিওয়েটদের। এ কারণে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। তবে অনেকের বিষয়ে যোগসূত্র এখন গোয়েন্দাদের হাতে। দু-একদিনের মধ্যে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে। এ চক্রের সদস্যরা মদ-ইয়াবা-গাজা-আইস ও এলএসডির মতো ভয়ঙ্কর সব মাদকের সাপ্লাইয়ার বলে তদন্তে ওঠে আসছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ জোনের ডিসি মশিউর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, নোবেল কাণ্ডের পর সংগীতাঙ্গন জুড়ে মাদকের ভয়াবহ একটি র্যাকেটের সন্ধান পাওয়া গেছে। তারা অনেক উঠতি বয়সিদের মাদকাসক্ত করে তুলছেন বলে তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে যাচাই-বাছাই শেষে দ্রুতই আইনের আওতায় আনা হবে।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ১ আগস্ট রোববার রাতে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায়ের অভিযোগে বারিধারা ও মোহাম্মদপুর এলাকায় পৃথক পৃথক অভিযান চালিয়ে ইয়াবা, মদ ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্যাদিসহ মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দুই মামলা এখন বিচারাধীন।
গ্রেফতার পিয়াসা ২০১৭ সালে রাজধানীর রেইন্ট্রি হোটেলে দুই নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় প্রথমে সাক্ষী ও পরে মামলা তুলে নেয়া জন্য বাদীকে হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসেন পিয়াসা। ওই ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত ছিলেন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে এবং পিয়াসার সাবেক স্বামী সাফাত আহম্মেদ। এরপর ওই বছরের ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় মোসারাত জাহান মুনিয়া নামে এক তরুণীর লাশ।
এ ঘটনায় মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া বাদী হয়ে দায়ের করেন মামলা। ওই মামলায়ও বাদী পিয়াসার নাম উল্লেখ করেন। সব মিলিয়ে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় প্রকাশ পেলেই যেন সেখানে পিয়াসার নাম চলে আসাটা একটা রীতিতে পরিণত হয়।
ওইসব ঘটনার পর গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত থাকার কারণে রাতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড কিছুদিন বিরত থাকলেও সম্প্রতি নোবেলকাণ্ডের পর ফের আলোচনায় আসে মাদককাণ্ড। তবে এবার শোবিজ ছাড়িয়ে মাদকের থাবা পড়েছে সংগীতাঙ্গনে। এ কারণে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে বলে গোয়েন্দারা জানান।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ